ভারতীয় সিনেমায় লিপকিসের ইতিহাস

ভারতবর্ষের সিনেমায় ঠোঁটে চুম্বন বা লিপকিস হাল আমলের নয়। সব দোষ যেন ইমরান হাশমীদের মতো অভিনয়শিল্পীদের। অন স্ক্রিন লিপকিস আদৌ দোষের কিনা—তাইবা ঠিক করবে কে? যাহোক, লিপকিস আগেও ছিল। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকেই হিন্দি সিনেমায় লিপকিসের দৃশ্য ছিল। এখন সিনেমার দৃশ্যে লিপকিস দেখলে আমরা হায়হায় করে উঠি। তখন বরং বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক ছিল। তখনকার নারী অভিনয়শিল্পীরাও ছিলেন উদার। বিশ ও তিরিশের দশকেও লিপকিস মামুলি বিষয় ছিল। কারণ, সেসময় ভারতীয় সিনেমায় পাশ্চাত্য সিনেমার প্রভাব পড়ছিল। আবার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যৌথ প্রযোজনাও তখন শুরু হয়ে যায়।

১৯৩৩ সালের ‘কর্মা’ সিনেমায় দেবিকা রানী এবং তার পরিচালক স্বামীর চার মিনিটের চুম্বনের দৃশ্য ছিল। তবে অভিনেত্রী সীতা দেবীই প্রথম—যিনি হিন্দি সিনেমায় লিপকিসের উদ্বোধন করেন। ১৯২৯ সালের নির্বাক সিনেমা ‘এ থ্রো অব ডাইস’–এ তিনি চারু রায়কে চুম্বন করেন। এই সিনেমাটি মহাভারতের গল্প অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছিল। সেসময়ের আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী জুবেইদা তার অভিনীত ‘জরিনা’ (১৯৩২) সিনেমায় চুম্বনদৃশ্যে অভিনয় করেছেন। কুড়ির দশকে ললিতা পাওয়ার ‘পতি ভক্তি’ সিনেমায় একই ধরনের দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন।

এই সাহসী অভিনেত্রীরা শুধু চুম্বনদৃশ্যে অভিনয়ই করেননি—তারা পুরুষ–শাসিত সিনেমা জগতেও আঘাত করেন। সেই সময়ে তারা রক্ষণশীলতার আগল ভেঙে বলিউডে একটি নতুন পথ তৈরির চেষ্টা করেছেন।

ভারতীয় সিনেমার প্রথম চুম্বনদৃশ্য

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর যখন ‘ফিল্ম অ্যাডভাইসরি বোর্ড’ হয় তখন থেকেই হিন্দি সিনেমা রক্ষণশীল হওয়া শুরু করে অথবা রক্ষণশীল হতে বাধ্য হয়। বোর্ড চাইতো নব্য গঠিত ভারতের সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি যেন সিনেমায় দেখা যায়। সেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে তৈরি হয় ‘সিনেমাটোগ্রাফ আইন ১৯৫২’। এই আইন অনুযায়ী সিনেমায় চুম্বন ‘অশ্লীল’। ফলে নিষিদ্ধ হয় এধরনের দৃশ্য। ধীরে ধীরে এই আইন প্রায় সবধরনের ঘনিষ্ট দৃশ্যের বিরুদ্ধে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

প্রেমের দৃশ্য সিনেমায় ফুটিয়ে তুলতে নির্মাতারা তখন বিকল্প পথ খুঁজতে শুরু করলেন। ঘনিষ্ট দৃশ্যকে তখন প্রতীক ও ইঙ্গিতে দর্শকদের বুঝানোর রেওয়াজ শুরু হয়। প্রতীকগুলোর মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল দুটি ফুলের কাছাকাছি আসার দৃশ্য। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চুম্বনের দৃশ্যের পরিবর্তে বনের মধ্যে নায়ক–নায়িকার দৌড়ানোর দৃশ্য জায়গা করে নেয়। যৌনসম্পর্ক বুঝাতে অনেক সিনেমায় আগুন দেখানো হতো। যেমন—১৯৬৯ সালের ‘আরাধনা’ সিনেমার ‘রূপ তেরা মাস্তানা’ গানে নর–নারীর ঘনিষ্টতা বুঝাতে আগুনে ক্যামেরা প্যান করা হয়েছিল।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সিনেমাগুলো ছিল দারুণ রোমান্টিক। কিন্তু সেই অর্থে রোমান্সকে সৃজনশীলভাবে নির্মাতারা প্রকাশ করতে পারছিলেন না। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে নির্মাতারা এই রক্ষণশীল সমাজ ভাঙতে নেমে পড়লেন। ধীমান নির্মাতা ও অভিনেতা রাজ কাপুর কখনো সেন্সর বোর্ডের বিধি–নিষেধ মানেননি। তিনি ঠিকই তার সিনেমাগুলোতে যৌন আবেদনের দৃশ্য দেখিয়েছেন। তিনি তার নায়িকাদের সুইমিং স্যুট ও ভেজা শাড়ি পরিয়েছেন। ১৯৭৩ সালের জনপ্রিয় ‘ববি’ সিনেমায় তিনি চুম্বনদৃশ্য রেখেছেন। ১৯৭৮ সালে রাজ কাপুর আরো একবার বৈপ্লবিক কাণ্ড ঘটালেন ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ সিনেমা করে। সে ছবিতে তিনি শশী কাপুর ও জিনাত আমানের লম্বা চুম্বনদৃশ্য যোগ করেছিলেন। তার পরিচালিত আরো একটি সিনেমা ‘রাম তেরি গঙ্গা মেইলি’ (১৯৮৫)। সে সিনেমায় অভিনেত্রী মন্দাকিনীর ঝর্নায় গোসল করার একটি খোলামেলা দৃশ্য রয়েছে। সে দৃশ্য নিয়ে তখন তুমুল বিতর্ক দেখা দেয়।

এসব প্রথাবিরোধী পদক্ষেপের কারণে বলিউড আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। আশির দশকের পরের নির্মাতা–অভিনয়শিল্পীরাও সংস্কার ভাঙতে এগিয়ে আসা শুরু করেন। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ডিম্পল কাপাডিয়া হয়ে উঠেছিলেন ‘যৌন–স্বাধীনতা’র প্রতীক। ‘সাগর’ (১৯৮৫) সিনেমায় ঋষি কাপুরকে এবং ‘জাঁবাজ’ (১৯৮৬) সিনেমায় অনিল কাপুরকে চুম্বন করে ডিম্পল আলোচনার ঝড় তোলেন। ১৯৮৮ সালের ‘দয়াবান’ সিনেমায় মাধুরী দীক্ষিত ও বিনোদ খান্নার ঘনিষ্ট দৃশ্য—এককথায় দুঃসাহসিক। ১৯৮৮ সালের ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তাক’ সিমেনায় আমির ও জুহিও তথাকথিত সেই সীমা কম লঙ্ঘন করেনি।

নব্বয়েরই দশকে এসে হিন্দি সিনেমায় চুম্বন ও অন্যান্য ঘনিষ্ট দৃশ্য আবার সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ সালের ‘রাজা হিন্দুস্তানি’ সিনেমায় কারিশমা ও আমিরের প্রায় এক মিনিট লম্বা চুমুর দৃশ্য ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আর একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই এসব দৃশ্যের গায় আর কোনো সংস্কারের খোলস থাকেনি। ২০০৩ সালের ‘খোয়াহিশ’ সিনেমায় মল্লিকা শেরাওয়াত ও হিংমাশু মালিক মোট সাতবার চুম্বনদৃশ্যে অভিনয় করেছেন। দৃশ্যগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা পায়—যদিও সিনেমাটি ফ্লপ। নেহা দুপিয়াও ‘জুলি’ (২০০৪) সিনেমায় যৌনদৃশ্যে অভিনয় করেছেন। তবে এসব আলোচনাকে ছাড়িয়ে যায় অনুরাগ বসুর ‘মার্ডার’ (২০০৪) সিনেমা। মূলত সিনেমায় নয়—যৌনদৃশ্যে অভিনয় করেই মল্লিকা শেরাওয়াত ও ইমরান হাশমী রাতারাতি তারকা বনে যান। এর পর ‘ধুম ২’তে হৃতিক ও ঐশ্বরিয়া, ‘যাব উই মেট’–এ শহিদ কাপুর ও কারিনা কাপুর এবং ‘ইশকিয়া’ সিনেমায় বিদ্যা বালান ও আরশাদ ওয়ার্সীর ঘনিষ্টদৃশ্য ‘সিনেমেটিক রক্ষণশীলতা’র গায় আঘাত করে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে ভারতীয় সিনেমা আবার ইউটার্ন নিয়ে সেখানে ফিরে আসে—যেখানে তা ছিল।

তথ্যসূত্র : নিউজ এইটিন 

এমন আরো সংবাদ

সর্বশেষ বিনোদন