একজন আজগর ফরহাদি

অস্কার হাতে আজগর ফরহাদি

এবারের ৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে যৌথভাবে গ্র্যান্ড প্রিক্স পুরস্কার অর্জন করছে ‘দ্য হিরো’ সিনেমা। সিনেমাটি আজগর ফরহাদির তৈরি। আজগরকে কে না চেনে! কে না জানে! বিশ্বসিনেমায় সবচেয়ে আলোচিত নামের একটি আজগর ফরহাদি। তিনি তার সিনেমায় এমন গল্প বলেন যা অনেক নির্মাতা এড়িয়ে যান। গতানুগতিক চিত্রনাট্যে তিনি বিশ্বাসী না। জীবন যেখানে যেমন—সেভাবেই তিনি তা পর্দায় ফুটিয়ে তোলেন। অনেক নির্মাতা যে ঘটনা ও কাহিনীকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন আজগর অনেক সময় সেই মামুলি বিষয়কেই গুরুত্বপূর্ণ এবং চিন্তার খোরাক হিসেবে সামনে আনেন।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে আজগর বলেছেন, ‘আমরা যদি ট্যাবুহীন পৃথিবীতে বাস করতে পারি, যদি নিষিদ্ধ প্রশ্ন বলে কিছু না থাকে তখন আমি মনে করবো সত্যিই পরিবর্তনটা শুরু হয়েছে।’ তিনি তার সিনেমা দিয়ে সমাজের ট্যাবুকে আঘাত করতে চান, সমাজকে প্রশ্ন করতে চান। তবে তিনি নিজে কোনো উত্তর দেন না। আরেক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমার ক্যামেরা দর্শকদের কোনো আইডিয়ার দিকে যেন ঠেলে না দেয় সে বিষয়ে আমি সচেষ্ট থাকি।…আমি আমার ক্যামেরাকে জাজমেন্টাল হতে দিই না।’ তার সিনেমার চরিত্রগুলোও সাদামাটা। তার তৈরি চরিত্রগুলো গতানুগতিক বীরত্বপূর্ণ, মহান ও আর্দশবান নয়। সমাজের আট-দশটা রক্ত-মাংসের মানুষকেই আমরা তার সিনেমায় দেখি। তিনিই জানিয়েছেন, ‘আমি আমার চরিত্রগুলোকে ভালো-মন্দে বিভিক্ত করি না।’

তার সিনেমা ভীষণ বাস্তবধর্মী। আজগরের কথায়, ‘আমার সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এগুলো দেখতে ডকুমেন্টারির মতো। আমি চাই সিনেমাগুলো যেন বাস্তব জীবনের মতো মনে হয়, সিনেমার মতো নয়।’ সাধারণ মানুষের অসাধারণ—কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সিনেমায় মেলে ধরতে আজগরের মতো করে খুব কম চলচ্চিত্রকারই পারেন।

তার নতুন সিনেমা ‘দ্য হিরো’ কান উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘পাম ডিঅর’ (গোল্ডেন পাম)-এর জন্য লড়েছে। অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন এই সিনেমাই বাজিমাত করবে। তা অর্জিত না হলেও প্রশংসা ও সম্মান জুটেছে অনেক। নিজের করা তৃতীয় সিনেমা থেকে আজগরের পুরস্কার পাওয়া শুরু। তখন থেকে এখন পর্যন্ত তার এমন কোনো সিনেমা নেই যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মানিত হয়নি।

একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের সেরা বিদেশি ভাষার সিনেমা বিভাগে দুবার পুরস্কার পেয়েছেন এই ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার। ‘এ সেপারেশন’ ছবির জন্য ২০১২ সালে এবং ২০১৭ সালে ‘দ্য সেল্সম্যান’ ছবির জন্য। ‘দ্য সেল্সম্যান’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চিত্রনাট্য বিভাগেও পুরস্কার অর্জন করেছিল। তাকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ ‘লিজেন অব অনার’ সম্মাননা দেয়া হয়েছে। ২০১২ সালে টাইম ম্যাগাজিন বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির যে তালিকা প্রকাশ করেছিল সেখানে আজগরের নাম ছিল। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের করা শীর্ষ ১০০ বিশ্বচিন্তকের তালিকায়ও তিনি জায়গা করে নেন। ৬২তম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে আজগর জুরি সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাহী আদেশের নামে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান প্রবেশ নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ৮৯তম অস্কার আয়োজন তিনি বয়কট করেছিলেন।

আজগর ফরহাদির জন্ম ১৯৭২ সালের ৭ মে। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রামাটিক আর্টসে বিএ এবং তারবিয়াত মোদারেস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  মঞ্চ নির্দেশনায় এমএ করেন। শুরুর দিকে তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করতেন। টিভি সিরিয়ালও নির্মাণ করেছেন। ২০০৩ সালে তৈরি করেন প্রথম সিনেমা—‘ড্যান্সিং ইন দ্য ডাস্ট’। পরের বছর বানান ‘দ্য বিউটিফুল সিটি’। ২০০৬ সালে তার তৃতীয় সিনেমা ‘ফায়ারওয়ার্কস ওয়েন্সডে’ শিকাগো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ড হিউগো’ পুরস্কার পেয়ে যায়।

এরপরের সবগুলো সিনেমাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে দেয়। ২০০৯ সালে আসে আজগরের চতুর্থ সিনেমা ‘অ্যাবাউট অ্যালি’—যা ৫৯তম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালক এবং ট্রাইবেকা চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা সিনেমার পুরস্কার অর্জন করে। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র-তাত্ত্বিক ডেভিড বোর্ডওয়েল ‘অ্যাবাউট অ্যালি’কে ‘মাস্টারপিস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ‘এ সেপারেশন’ সিনেমা আজগরকে শুধু অস্কারই নয়—এনে দিয়েছে ৬১তম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা সিনেমার পুরস্কার, গোল্ডেন গ্লোবের সেরা বিদেশি ভাষার সিনেমাসহ আরো কয়েকটি মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া তার আরো দুটি আলোচিত সিনেমা—‘দ্য পাস্ট’ (২০১৩) এবং ‘এভরিবডি নোস’ (২০১৮)। ২০২১ সালে তৈরি করেছেন ‘দ্য হিরো’।

এমন আরো সংবাদ

সর্বশেষ বিনোদন