তিনি আছেন, থাকবেন স্বমহিমায়

লতা মঙ্গেশকর

পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি গান গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর, চিতার আগুনে আমাকে পোড়াতে পারবে/ সাদা ছাইগুলো বাতাসে ওড়াতে পারবে/ আমার গানকে পোড়াতে পারবে না/ পোড়াতে পারবে জানি আমার গানের এই কাগজগুলো/ তানপুরাটার তারে ছড়াতে পারবে জানি অনেক ধুলো/ শুধু যে গান রইলো পড়ে হৃদয়জুড়ে সে গান থামাতে পারবে না।
গানের কথাগুলো লতা মঙ্গেশকরের নিজের জীবনের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। সিনেমায় গানটি ওঠে শতাব্দী রায়ের ঠোঁটে। কিন্তু আমি নিশ্চিত শতাব্দীকে ভেবে নয়—গানটি লেখা হয়েছিল লতাকে ভেবেই।

আমার সঙ্গে চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর—এমনকি আশির দশকে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া গানের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। কিন্তু আছে। আমি সম্ভবত তার সবগুলো কমবেশি জনপ্রিয় গান শতবার শুনেছি। অনেক গান আমার মুখস্ত। বাবা প্রচুর পুরোনো হিন্দি গান শুনতেন। আমাদের বেড়ার ঘরে দামি জিনিস বলতে ছিল একটি অডিও ক্যাসেট প্লেয়ার। ঘরে বাজার থাকুক না থাকুক পুরোনো দিনের গানের নতুন ক্যাসেট থাকতোই। আর সবগুলো জুড়েই ছিল লতা মঙ্গেশকর। কোনো অনুষ্ঠান হলে বাবা স্পিকার ভাড়া বা ধার করে নিয়ে আসতেন। বাজাতেন সেসব মনে রাখার মতো গান। লতার যে গানটি প্রথম আমার মাথায় ঢুকে যায় তা হলো, আজা আই বাহার/ দিল হ্যা বেকরার/ ও মেরে রাজকুমার/ তেরে বিন রাহা নানা যায়ে। কোনো এক অনুষ্ঠানে বাবা বারবার গানটি বাজিয়ে ছিলেন। আমার বয়স তখন তিন কি চার বছর। শুনতে চাই আর না চাই—সেসব গান কান হয়ে জায়গা করে নিলো মননে। আমার গানের প্রতি তীব্র অনুরাগের শুরুটাও তখন থেকেই।

অবাক হতাম, যত গান শুনি তার বেশিরভাগ লতার!আমার কাছে হিন্দি গানে নারীর কণ্ঠস্বর মানেই লতা। আমার জন্মের আগের লতা তো মোহগ্রস্ত করে রেখেছিলেনই—আমাদের সময়েও দেখি লতারই জয়জয়কার। আমাদের প্রজন্ম তাকে সরাসরি পেলো নব্বইয়ের দশকে।

লতা মঙ্গেশকর

তার কণ্ঠ সেই চল্লিশের দশক থেকে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত একটানা ভারতীয় ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রিতে কিভাবে রাজত্ব করলো? প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেতা দিলীপ কুমার বলেছিলেন, ‘‘লতার কণ্ঠ কুদরতের এক বিস্ময়’’। আর আনন্দবাজার পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, মান্না দে বলেছিলেন, “যে যতো ভালই গাক। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ঈশ্বর বাস করেন। ওর মতো কেউ গাইতে পারবে না।” আমার মনে হয়েছে, লতার কণ্ঠের কেরামতির পেছনে কাজ করে তার সরলতা। তার গোটা জীবনযাপন সরলতায় সমৃদ্ধ। তার কনসার্টগুলো দেখলে অবাক হতে হয়। উঁচুউঁচু নোট ধরতেও তাকে কসরত করতে হচ্ছে না। অবলীলায় তিনি গেয়ে চলেন একের পর এক গান। তার যেকোনো লাইভ কনসার্টের ভিডিও দেখুন, আপনি তার ওপর থেকে চোখ সরাতে পারবেন না। আপনাকে সম্মোহিত ও বিস্মিত করে রাখবে তার সরল গায়কী। তিনি বাচ্চাদের মতো করে কথা বলেন, হাসেন এবং হাসান। আর এই সরলতা থেকেই আসে বিনয়। তাকে সুরসম্রাজ্ঞী বলা হয়, কিন্তু তার কথাবার্তায় বা আচরণে অহংবোধের লেশমাত্র দেখা যায় না।

তিনি নিজেই একবার বলেছেন, তিনি সিনেমার গান গাওয়ার সময় গানের শব্দে জোর দিতেন এবং যে অভিনেত্রীর জন্য গানটি করছেন তার কথা মাথায় রাখতেন। গানের শব্দের অর্থ ও অভিনেত্রীর ‘এক্সপ্রেশন’ অনুসরণ করেই তিনি গানটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতেন। পর্দার অভিনেত্রীকে গভীরভাবে জানার কারণে গানটি অভিনয়ের পথ ধরে মানুষের মনে জায়গা করে নিতো বলেই আমার ধারণা।

তার বিপুল সফলতার পেছনে আরো এটি কারণ —তার সময়। সেসময়ের পরিচালক, সংগীত পরিচালক, গীতিকার এবং নায়ক-নায়িকা কারা ছিল দেখুন। সবার মধ্যে কিছু করে দেখানোর চেতনা ছিল। তখনো লোভ সবাইকে গ্রাস করে ফেলতে পারেনি। বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করতেন। সময়টার একটা উল্টো দিকও আছে, আজকের মতো উন্নত প্রযুক্তি না থাকায় সেসময় পরিশ্রমও অনেক করতে হতো।

লতা মঙ্গেশকর ও এআর রহমান

সেসময় খুব বেশি নারী কণ্ঠশিল্পী ইন্ড্রাস্ট্রিতে ছিলেন না।  আর দেশভাগের পর নতুন ভারত নতুন মুখ খুঁজছে—যাদের কাজে ভারতের নিজস্বতা জ্বলজ্বল করবে। সেসময় লতা হয়ে উঠলেন অন্যতম কাণ্ডারি। একে তো তিনি বিস্ময়কর প্রতিভা—তারওপর প্রতিদ্বন্দ্বী হাতেগোনা। পুরুষ কণ্ঠশিল্পী সে তুলনা বেশি ছিল। আর সংগীত পরিচালকেরা তখনই বুঝেছিলেন লতার কণ্ঠ কালজয়ী হবে। সুতরাং সবাই লতাকে নিয়ে পড়লেন।

একঝাঁক নারী কণ্ঠশিল্পী পেতে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হলো, আশি-নব্বই দশক পর্যন্ত। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই যুগেও নতুন সিনেমা ও সংগীতের সঙ্গে নিজেকে চমৎকারভাবে খাপ খাইয়ে নিলেন লতা।প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ কণ্ঠশিল্পীদের সহকর্মী হয়ে গেলেন ষাটোর্ধ্ব ‘লতা দিদি’। এসময়ও একের পর এক হিট গান দিলেন তিনি। কাজ করছেন নাদীম-শ্রাবণ, অনু মালিক, যতীন-ললিত, এআর রহমান—সবার সঙ্গে।  তার কণ্ঠ হয়ে উঠলো মাধুরী, কাজল, কারিশমা, টাবু ও প্রীতি জিনতার কণ্ঠ। বিংশ শতাব্দীর শেষ এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরু—সিনেমার রং ও রূপ আমূল বদলে গেলো কিন্তু লতা রইলেন স্বমহিমায়।

তিনি যেমন দিয়েছেন, পেয়েছেনও অনেক। জীবদ্দশায় কোটি কোটি শ্রোতার অকুণ্ঠ ভালোবাসা কুড়িয়েছেন। নিজেকে দেখে যেতে পেরেছেন গানের রানী হিসেবে। এই সুযোগ কজনের হয়! বাকি রইলো অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব জাতীয় পুরস্কার? এসব পুরস্কার একাধিকবার পেয়েছেন এমন অনেক শিল্পীকে পৃথিবী মনে রাখেনি। এসব না পেয়েও লতা সংগীতপ্রেমীদের মনে রাজত্ব করছেন যুগের পর যুগ। লতার কণ্ঠ পুরস্কারের বহু ঊর্ধ্বে।

টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে গুলজার বলেছিলেন, “তার কণ্ঠ অবিস্মরণীয়। শতাব্দীতে যে কোনো একজনই এই ধরণের কণ্ঠের অধিকারী হতে পারেন। তিনি আমাদের জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাকে ছাড়া সংগীত অসম্পূর্ণ।” একথার পর আর কথা থাকে না। যাকে দেখে, শুনে এবং মনে ধারণ করে বড় হয়েছি—সেই লতাজির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

সুদীপ্ত সালাম দৃশ্য-গল্পকার ও লেখক
ইমেইল ঠিকানা: dakgharbd@gmail.com

এমন আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ বিনোদন