‘বিভা ও বিভ্রম’ ছোট্ট একটি উপন্যাস। সাদাত হোসাইনের এই বইটি বের করেছে প্রথমা। তার আগে ছাপা হয় দৈনিক প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায়। আমি নিশ্চিত সাদাত হোসাইনের নিন্দুকেরাও যদি বইটি পড়েন প্রশংসা না করে পারবেন না। বাংলাদেশের উপন্যাসধারায় এমন জটিল মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস খুব কম লেখা হয়েছে।
গতবছরের মার্চে বইটি বের হলো, কিন্তু এখনো বইটির প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়নি, সাদাতের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা বিরল। এই বই তার অন্যান্য বইয়ের চেয়ে বেশি বিক্রি হওয়ার কথা। কারণ, প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় ছাপা হয়েছে, প্রথমার মতো বনেদি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বের করেছে, বইটি আকার ও দামে কম এবং লেখকের অন্যান্য উপন্যাসের চেয়ে এটি একেবারে ভিন্ন। তারপরও প্রথম মুদ্রণ একবছরেও শেষ হলো না কেন? দুটি কারণ থাকতে পারে, হয় প্রথমা প্রথম মুদ্রণেই কয়েক মুদ্রণের সমপরিমাণ কপি বের করেছে, নাহয় সাদাত ব্রাহ্মণদের দিয়ে গঠিত ‘জাতীয় সাহিত্যনিয়ন্ত্রক কমিটি’র রাজনীতির শিকার। এই কমিটি সম্পর্কে পরে বলা যাবে। এখন বইটি সম্পর্কে বলি।
বইটি মূলত আলতামাশ নামের এক চোট খাওয়া তরুণের মনোবিশ্লেষণ। উপন্যাসেই তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আজন্ম উপেক্ষিত, ব্যর্থ, বঞ্চিত, তুচ্ছ এক মানুষের প্রতিভূ আলতামাশ তার জীবনের সব অস্পৃশ্য স্বপ্ন এভাবে স্পর্শ করার অলৌকিক এক ভাবনায় ক্রমশই বিভোর হয়ে থাকতে লাগল। তার বাস্তব ক্রমশই ডুবে যেতে থাকল কল্পনায়।’ এই বাস্তব ও অবাস্তবের মাঝবরাবর ঝুলে থাকা মানুষের জীবনের বয়ানই ‘বিভা ও বিভ্রম’।
পৃথিবীতে সে কোনো এলিয়েন নয়, সেও রক্তমাংসের মানুষ। তার এই জটিল জীবনের একটি ইতিহাস আছে, ‘আলতামাশের মাথায় শৈশবের ভয়ঙ্কর স্মৃতিগুলো স্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে’ বলেই সে স্মৃতিবন্দী এক মানুষ। ‘খাঁচায় জন্মানো পাখি যেমন মুক্ত আকাশ পেলেও উড়তে পারে না, আলতামাশও তেমন সব পেয়েও কিছুই নিতে জানে না। না ভালোবাসা, না বন্ধুত্ব, না জীবন।’ উপন্যাস পড়তে পড়তে আপনার এই টগবগে তরুণের প্রতি বিরক্তি ও ঘৃণা জন্মাবে, আবার একসময় তার প্রতি সহমর্মিতার পারদও উপরে উঠতে থাকবে। পাঠকও দ্বন্দ্বে পড়ে যান, তাকে ঘৃণা করবেন নাকি তার প্রতি সমব্যথিত হবেন। তবে উপন্যাসের একপর্যায়ে আলতামাশের উপলব্ধি আসে, ‘সম্পর্কের বন্ধনবিহীন পৃথিবী যেন এক ধূসর, রুক্ষ মরুপ্রান্তর।’ গল্পের মোড় ঘুরে যায় এখানেই, আলতামাশের এই উপলব্ধি যেভাবে হয়—তা চমকপ্রদ ও অপ্রত্যাশিত। তা উপভোগ করতে বইটি পড়তে হবে।
এটি সাদাতের একটি নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস এবং তাতে তিনি সফল হয়েছেন। পাঠকেরা কেন্দ্রীয় চরিত্রের সঙ্গে একাকার হয়ে যাবেন—কেননা আমরা সবাই কমবেশি স্মৃতির ফ্যান্টাসিতে বসবাস করি।