তারেক মাসুদকে কি প্রশ্ন করেছিলেন সত্যজিৎ রায়

সত্যজিৎ ও তারেক মাসুদ। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অগ্রযাত্রায় যে ধীমান মানুষটির আধুনিক চিন্তা ও কর্ম বিশেষ ভূমিকা রেখেছে তিনি নির্মাতা তারেক মাসুদ। আর এই উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। বাংলাদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের জন্ম ১৯৫৬ সালে। ২০১১ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি অকালে প্রাণ হারান। ওদিকে সত্যজিতের জন্ম ১৯২১-এ। তিনি ১৯৯২ সালে শেষঃনিশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রশ্ন হলো, এই দুই গুণী নির্মাতার সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা। উত্তর, হ্যাঁ হয়েছিল। সেই ১৯৮৫ সালে।

নির্মাতা, চিত্রশিল্পী ও সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের প্রতি তারেক মাসুদের ছিল বিশেষ অনুরাগ। ফেলুদার স্রষ্টাকে তিনি ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন। তারেক তার ‘সত্যজিৎ ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে বলছেন, ‘‘বড় মাপের শিল্পীরা দুই প্রকারের হন। প্রথম প্রকারের শিল্পীরা নতুন চিন্তা বা ভাবধারার উন্মীলন ঘটিয়ে কিংবা তাদের নিজস্ব শিল্পকাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন এনে একটি বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু আরেক ধরনের শিল্পীও আছেন, যারা সমাজকে বদলে না দিয়ে কিংবা তাদের শিল্পমাধ্যমে বিপ্লব না ঘটিয়েও তাদের কাজের মধ্য দিয়ে সমগ্র সমাজের চূড়ান্ত ও সংশ্লেষী রূপ ধারণ করেন। এক্ষেত্রে তারা শিল্পীসমাজের সাংস্কৃতিক প্রতীকে পরিণত হন। সমস্ত পাপ ও পুণ্য, পূর্ণতা এবং সীমাবদ্ধতাসমেত সেই সমাজ শিল্পীর কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যজিৎ রায়—দুজনেই এই দ্বিতীয় প্রকারের শিল্পী।’’ তারেক মাসুদ রবীন্দ্রনাথকে পাননি, তার জন্মের অনেক আগেই বিশ্বকবি পরলোকগমন করেন। অন্য আরেকটি লেখায় তারেক মাসুদ সত্যজিৎ রায়কে ‘আধুনিকতম সময়ের আধুনিকতম শিল্পের শিল্পী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

সেই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তারেক মাসুদের অন্তত একবার দেখা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে তারেক চিত্রশিল্পী সুলতানের ওপর ‘আদম সুরত’ শিরোনামের তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন। তার মানে তারেক মাসুদ তখনো বিখ্যাত হয়ে ওঠেননি। তারেক সেসময় ‘চিত্রবাণী’র নিমন্ত্রণে কলকাতায় যান একটি চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ কোর্সে যোগ দিতে। একদিন চিত্রবাণীর পরিচালক ফাদার গাঁস্ত রোবের্জের সঙ্গে তিনি সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ পান। সত্যজিতের সঙ্গে প্রথম দেখার স্মৃতিচারণ করেছেন তারেক মাসুদ তার ‘সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতি’ শিরোনামের একটি লেখায়। এক সকালে সত্যজিতের বাড়িতে গিয়ে তারেক দেখলেন, ‘‘যেন সিনেমার শিল্পনির্দেশিত সাজানো সেটে সত্যজিৎ বসে আছেন। ডানে-বাঁয়ে-পেছনে বই আর কাগজপত্র। বাঁ কাঁধের গা ছুঁয়ে খোলা একটি বড় জানালা। সকালের তির্যক অথচ নরম আলো তার মুখের একদিকে এসে পড়েছে।’’

তারপর কথা হয় সত্যজিতের সঙ্গে তারেকের। ঢাকায় সত্যজিৎ মুস্তাফা মনোয়ার নির্দেশিত ‘রক্তকরবী’ নাটক দেখেছিলেন সে প্রসঙ্গে কথা হয়। তিনি আরো কথা বলেন আলোকচিত্রী আমানুল হক সম্পর্কে। সত্যজিৎ বলেন, একসময় ঢাকার সঙ্গে তার যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন আমানুল হক। তারপর সত্যজিৎ জানতে চান, তার সিনেমা বাংলাদেশে দেখানো হয় কিনা। তারেক মাসুদ জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ সীমিত পরিসরে দেখায়। তারেক আরো জানান, সত্যজিতের ‘জন-অরণ্য’ সিনেমা বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছে।

যেন সিনেমার শিল্পনির্দেশিত সাজানো সেটে সত্যজিৎ বসে আছেন। ডানে-বাঁয়ে-পেছনে বই আর কাগজপত্র। বাঁ কাঁধের গা ছুঁয়ে খোলা একটি বড় জানালা। সকালের তির্যক অথচ নরম আলো তার মুখের একদিকে এসে পড়েছে

সত্যজিৎ আটকে দেয়ার কারণ জানতে চান। তারেক বলেন, সিনেমাটি রাজনৈতিক। একথা শুনে ‘মহারাজা’
‘‘হো হো করে হেসে উঠলেন।’’ শেষে নিমন্ত্রণ পেলে বাংলাদেশে যাবেন কিনা জানতে চান তারেক মাসুদ। সত্যজিৎ রাজি হননি, জানিয়েছিলেন, ‘‘বুড়ো বয়সে ও ধকল সইবে না।’’ প্রায় এক ঘণ্টার এই আলাপচারিতা শেষে তারেক মাসুদের উপলব্ধি, ‘‘একটা ‘বুদ্ধিদীপ্ত’ প্রশ্নও তাকে (সত্যজিৎ) করতে হলো না, অথচ মানুষটি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম, বুঝতে পারলাম! আর কত চমৎকারভাবে আমাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে উনি কত কিছুই জেনে নিলেন।’’ আড্ডা শেষে সত্যজিৎ রায়ের অটোগ্রাফ নেন সেসময়ের প্রতিশ্রুতিশীল চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ।

এমন আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ বিনোদন