আমার প্রতিবেশী রাহিদ সাহেব বেশ অদ্ভুত মানুষ। অদ্ভুত কেন বলছি? বৃষ্টি তার একদমই পছন্দ নয়, তার পছন্দ শীতকাল। আমারও শীতকাল পছন্দ, তবে বৃষ্টি অপছন্দ নয়। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে রাত তিনি একদমই পছন্দ করেন না। হোক সেটা অভিমানী প্রেমিকার মন ভালো করে দেয়া জ্যোৎস্নারাত অথবা ঝিঁঝিঁ ডাকা, জোনাকজ্বলা কাব্যময় অমানিশা। তার সাথে পরিচয়ের সাত মাস কেটেছে, একবাড়ি পরেই তার আবাস, কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে একটি বারের জন্যও রাতে আড্ডা হয়নি আমাদের। জন্মদিন কিংবা যেকোনো রাতের আয়োজনে এটা-সেটা নানা অজুহাতে পানির মতো আঙুলের ফাঁক গলে ফসকে গেছে বারবার। দু-একবার তাকে রাতে বাইরে দেখেছি, তীব্র গরমেও হুডি কিংবা আলখাল্লা পোশাকে, সাতরঙা ছাতা মাথায়। ডেকেছি, সাড়া দেননি, তড়িৎ বেগে পালিয়েছেন।
তিনি কাজ করেন বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানে। তার কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন,
—পৃথিবীর বাইরে যে প্রাণগুলো আছে তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি ভাই।
লোকটার বন্ধুবান্ধব নেই খুব একটা, যদিও তার রসবোধ দারুন, আড্ডায় বেশ প্রাণবন্ত। একবার তার রাতের পোশাক নিয়ে ঠাট্টার ছলে বলেছিলাম,
—ভাই, এলিয়েনদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েই কি রাতের বেলা নিজেকে এলিয়েনদের মত বানিয়ে রাখেন?
তিনি বললেন,
—আমি যদি ব্যর্থই হতাম তাহলে আপনার সাথে যোগাযোগ হতো না। (কিছুক্ষণ চুপ থেকে হো হো করে হেসে উঠলেন)
কথা ঘুরিয়ে তার পোশাকের বিষয়ে আলোচনা তুলতেই তিনি আমাকে থামিয়ে দিলেন,
—আয়নায় নিজের কানটা দেখেছেন? আজ ভালো করে দেখবেন। সাথে চোখ দুটোও। ওগুলো সাধারণের সাথে মেলে না। (বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন)
আমার সেদিন বেশ মেজাজ খারাপ হয়েছিল। তার নিজের একটা পা ছোট, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। দেখতে আমার চাইতে একটু ফর্সা, তাতে কি! কারো কাছে জানতে চাইলে অবশ্যই আমাকে সুদর্শন বলবে। সেদিন বাসায় ফিরে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। হ্যাঁ, আমার কান হয়তো একটু বড়, চোখ দুটো হয়তো এক রকম নয়। তাই বলে সে আমাকে এলিয়েন বলবে? এরপর তিন দিন তার সাথে কথা বলিনি, দেখাও করিনি।
সেদিন আমার পছন্দের রসমালাই নিয়ে যদি তিনি দেখা করতে না আসতেন, তাহলে হয়তো আর কোনোদিন দেখাও হতো না। না হলে হয়তো ভালোই হতো।
তার কয়েকদিন পর তিনি আমাকে একটি কলম উপহার দিয়েছিলেন। কলমটা দেখতে ট্রান্সপারেন্ট। দেখে মনে হচ্ছিল কলমটিতে আলো জ্বলে। জিজ্ঞেস করতেই বলেছিলেন,
– যত্ন করে রাখবেন, এর কালি কখনো ফুরাবে না। আর আলো? সেটা হয়তো জ্বলবে যখন আপনি যাদের এলিয়েন বলেন সেই ভাইয়েরা পৃথিবীতে আসবে এবং আপনার সাথে যোগাযোগ করতে চাইবে।
এরপর তিনি যেভাবে হেসে উঠলেন তা আমার এখনো মনে আছে। আমাকে কথায় হারিয়ে তার পৈশাচিক আনন্দের বহিঃপ্রকাশ আমাকে খুব বিব্রত করছে জেনেও তার উল্লাস থামেনি সেদিন।
তার সাথে আর কোনোদিন দেখা না হলে কেন ভাল হতো— এবার তা বলা যাক। সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমা। রুপালি আলোর আসক্তি আমাকে আবার কবি বানিয়ে দেয় কখনোবা গায়ক। সেদিন কবিও হয়েছিলাম গায়কও। ভাড়া বাড়ির ছাদে রাত কাটানো প্রায় অসম্ভব, তবে সেদিন সদা জাগ্রত শহরটিকেও ঘুমিয়ে পড়তে দেখেছি ছাদে বসে। আমারও যখন ঘুম ঘুম ভাব—ছাদ থেকে তখন চুপি চুপি নেমে আসার চেষ্টা করলাম। দুই তলা নিচে নামতেই শুনলাম গেটে একটা শব্দ হচ্ছে। ভাবলাম চোর এসেছে, দ্রুত নেমে দেখি গেট খোলা। কাছাকাছি গিয়ে দেখি গেটের পাশে একটি ব্যাগ রাখা। ব্যাগের উপরে রাহিদ সাহেবের সাতরঙা ছাতা, তার উপরে একটি কাগজের টুকরা, তাতে কিছু একটা লেখা। সামনে তাকাতেই দেখি রাহিদ সাহেব হেঁটে যাচ্ছেন। জ্যোৎস্নার এত আলো তবু তাকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না, তবে তার অবয়বটা পরিষ্কার— কালো কুচকুচে। মনে হচ্ছিল কলমে আঁকা কোনো স্কেচ। হাঁটছেনও সেই খুঁড়িয়ে চলার ছন্দেই। তার নাম ধরে ডাকতেই থমকে গেলেন, তবে পেছনে ফিরলেন না। বললেন,
– ব্যাগের ভেতরে কিছু বই আছে। ছাতা আর পোশাকগুলোও আমার আর দরকার নেই। বইগুলো পড়া শেষ হলে ওগুলো আপনার কাজে লাগতে পারে। আর হ্যাঁ, কলমটা অবশ্যই সাবধানে রাখবেন। আপনার সব প্রয়োজনের শুরু ও শেষ ওটাতেই। হয়তো আবার দেখা হবে, নয়তো না।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত চলে গেলেন। তার যাওয়াটা অস্বাভাবিক দ্রুতগতির ছিল। নিমেষেই গলি পেরিয়ে অদৃশ্য হলেন তিনি। তার পর পরই জ্যোৎস্না বেশ প্রকট হল, আমার ঘুমও। ব্যাগ, ছাতা আর চিরকুট নিয়ে ঘরে ফিরে দেখি, তার দেয়া কলমটি জ্বলছে আর নিভছে। ঘুম উড়ে গেলো। কলমটি নিয়ে এক দৌড়ে রাস্তার মোড়ে গেলাম। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠলো, কিন্তু কোনো শব্দ হলো না।
শুনেছি আমি চোখ মেলেছি তিনদিন পর। রাহিদ সাহেবের দেয়া কলমটি ততক্ষণে পাড়ি দিয়েছে বহু পথ। তার দেয়া চিরকুটে আর্চি ভাষায় লেখা ছিল, ‘বাইরে এলিয়েন খুঁজে লাভ নেই, সে তোমার মাঝেই। আয়নায় খুঁজে দেখো, তোমার জায়গা পাবেই।’
আজ রাহিদ সাহেবের গল্পটি ১৭ বছর ৩ মাস ৪ দিন ১৩ ঘন্টা ৫ মিনিট পর আমার সর্বস্ব বিক্রি করে পাওয়া ৫৭ লাখ ৬৫ হাজার ৩৭৫ টাকার কলমটি দিয়েই লিখছি। কিছুক্ষণ পর এ কলমটি আমার আর কোনো কাজে আসবে না। আমার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এইসব বই যার অক্ষর দিনের আলোয় দেখা যায় না, রাহিদ সাহেবের দেয়া সাতরঙা ছাতা, অথবা আলখাল্লা আর হুডি, হয়তো আপনার কাজে আসবে। নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখবেন। যদি মনে করেন এসব আপনার কাজে আসবে তবে ৬৫৫/ বি, জাহাবক্স লেনের নিচতলার বাঁপাশের ফ্ল্যাটে এসে নিয়ে যাবেন।
চাবি?
আপনি ভালো করেই জানেন চাবিটা কোথায়।