প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ ‘মার্ডার ইন দ্য হিলস’

 

‘গল্পে বৃত্ত মেলাতে গেলে নির্দিষ্ট গতিপথেই চলতে হয়, এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। ক্লাইম্যাক্সে যেনতেন প্রকারেণ অঙ্ক যেনো মেলাতেই হতো। সে তো না হয় হল! কিন্তু গল্পের রহস্য ফাঁস হওয়ার পর এতোটা আবেগের ইঞ্জেকশন না দিলেও চলতো। এখনকার দর্শকদের মনে হয় সমস্ত কিছু হরলিক্সের মতো গুলিয়ে না খাইয়ে দিলেও চলে।’ কলকাতার সংবাদ প্রতিদিন এভাবেই ‘মার্ডার ইন দ্য হিলস’-এর মূল্যায়ন করেছে। ২৩ জুলাই ‘হইচই’-এ মুক্তি পেয়েছে অঞ্জন দত্ত পরিচালিত এই আট পর্বের ওয়েব সিরিজ। মুক্তির পর থেকেই তা নিয়ে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেছেন। অঞ্জন দত্তের করা প্রথম ওয়েব সিরিজ—তাই দর্শকের প্রত্যাশা ছিল অনেক। মনে হচ্ছে সে প্রত্যাশা পূরণে সফল হয়নি ‘মার্ডার ইন দ্য হিলস’। কারণ হিসেবে বিঞ্জড্ ডটকম বলেছে, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্টোরিটেলিং—এই সিরিজে তারই বড্ড অভাব।…দর্শককে গল্পে টানতে ব্যর্থ হয়েছে এর চিত্রনাট্য।’

টনি রায় নামের একজন প্রখ্যাত অভিনেতার রহস্যময় মৃত্যুকে ঘিরে সিরিজের কাঠামো দাঁড়িয়েছে। তারই জন্মদিনের পার্টিতে তিনি হুট করে মারা যান। তার সাক্ষী একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক অমিতাভ। তার কাছে এটি পরিকল্পিত খুন মনে হয়। শুরু হয় তার গোয়েন্দাগিরি। সে আর সাংবাদিক থাকে না। কথাবার্তাও আর সাংবাদিকসুলভ থাকে না। অনেক চেষ্টার পর সে জানতে পারে—তাকে জানানো হয়, সে ছাড়া ওই জন্মদিনের পার্টিতে থাকা সবাই টনি রায়ের খুনি। পার্টিতে একজন উপস্থিত ছিল না—টনির স্ত্রী। সেও হত্যা-পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত। সবাই কোনো না কোনোভাবে টনি রায়ের কারণে ভুক্তভোগী। টনি ও টনির বাবা কারো মাকে হত্যা করেছে, কারো বাবাকে মেরেছে। আর টনির স্ত্রী পারিবারিক কলহের শিকার।

জানানো হয়নি, কিভাবে এতোগুলো সমমনা মানুষ একজোট হলো। চিত্রনাট্যের দুর্বলতার কারণে টনিকে হত্যা করার যুক্তিগুলোকেও সহজে চ্যালেঞ্জ করা যায়। খুনিরাই বলছে, আদালতে টনির অপরাধগুলো প্রমাণ করা যাবে না, তাই দলীয়ভাবে আইন হাতে তুলে নিয়ে বুড়োটাকে শেষ করে দিতে হবে। কয়েকজন খুনির হাতে কোনো প্রমাণই নেই যে টনি খুন করেছে, তারা শুধু শুনেছে, জেনেছে। তবে টনি খুনি, আমরা দর্শকেরা জানি। কারণ টনির অপরাধগুলো শুধুমাত্র আমাদের দেখানো হয়।

যাহোক, খুনিরা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও সফল। একজন চিকিৎসক, একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, একজন কোচ আর আরেকজন তো উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা। তারপরও তাদের আইন নিজ হাতে তুলে নিতে হবে। সিনেমার শেষে সব জেনে, সবার স্বীকারোক্তি রেকর্ড করেও কোনো পদক্ষেপ নেয় না আমাদের সেই অনুসন্ধানী সাংবাদিক অমিতাভ। সেও মেনে নেয়, খুনই সঠিক। কিন্তু খুনটাকে যৌক্তিক করা যায়নি, না যুক্তি দিয়ে—না চিত্রনাট্য দিয়ে।

অঞ্জন দত্ত

দু-একজনের অভিনয় ছাড়া বাকিদের অভিনয় গৎবাঁধা, একঘেয়ে ও মেকি মনে হয়েছে। সবচেয়ে ভালো করেছেন অর্জুন চক্রবর্তী, সুপ্রভাত দাস ও রজত গাঙ্গুলি। রাজদীপ গুপ্ত ও সৌরভ চক্রবর্তী অনেক বেশি অভিনয় করে ফেলেছেন—যাকে বলে ‘ওভার অ্যাক্টিং’।

অঞ্জন দত্ত রেডিও বাংলা নেটকে এই সিরিজ করার কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘পরিচালনা, অভিনয়, গান করার পাশাপাশি আমার একটা লেখক সত্তাও আছে। গল্প, চিত্রনাট্য, গান লেখা ছাড়াও একটা সময় আমি সাংবাদিকতা করেছি। নাটকও লিখেছি অন্যের হয়ে। আমার সেই সত্তাটাকে আবার ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন বোধ করছিলাম।’ কিন্তু সেই ‘লেখক সত্তা’টাকে কি সিরিজে আমরা দেখতে পেলাম? বেশিরভাগ দর্শকই বলছেন, ‘না’।

‘হইচই’-এ সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া মোশাররফ করিম অভিনীত ‘মহানগর’ যেমন বিপুল প্রশংসা পেয়েছে, ‘মার্ডার ইন দ্য হিলস’-এর কপালে তা জুটলো না। ‘মার্ডার ইন দ্য হিলস’ নিয়ে ‘হইচই’-এর ফেসবুক পোস্টগুলোর নিচে সাধারণ মানুষ মন্তব্য করছে। বেশিরভাগ মন্তব্যই নেতিবাচক। দর্শক হতাশ—অনেকে তো ক্ষুব্ধ। মণীষ জৈন লিখেছেন, এই সিরিজ ‘অঞ্জন বাবুর মতোই একঘেয়ে ও বোরিং।’ অনেকে এও বলছেন, এটি আগাথা ক্রিস্টির ‘মার্ডার ইন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’-এর নকল। অঞ্জন দত্ত তার সিরিজে আগাথা ক্রিস্টির নাম না নেয়ায়ও অনেকে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। অযৌক্তিকভাবে সিরিজ লম্বা করা বিষয়ে অনেক দর্শক মন্তব্য করেছেন। রে মহলদার নামের একজন লিখেছেন, ‘বেকার…চাইলে চার এপিসোড দিয়েই শেষ করতে পারতো…বেকার টেনে নিয়ে গেলো।’ শুভপ্রিয়া ব্যানার্জি মন্তব্য করেছেন, ‘অতীব বাজে’।

‘মার্ডার ইন দ্য হিলস’-এর কয়েকজন

তবে দার্জিলিংয়ের দৃশ্যগুলো সবার পছন্দ হয়েছে। নস্টালজিক হয়ে পড়ার মতো অপূর্ব সব দৃশ্য। আর যারা দার্জিলিংয়ে যাননি তারা এই দৃশ্যগুলো দেখে নির্ঘাৎ প্রেমে পড়ে যাবেন। মনোরম ড্রোন শটগুলো দিয়ে দার্জিলিংকে নতুন রূপে দর্শকদের সামনে হাজির করা হলো।

ওয়েব সিরিজটিতে অভিনয় করেছেন, অর্জুন চক্রবর্তী, রাজদীপ গুপ্ত, অনিন্দিতা বসু, সন্দীপ্তা সেন, সৌরভ চক্রবর্তী, সুপ্রভাত দাস ও অঞ্জন দত্ত নিজে। প্রথম সিজন মুক্তির আগে অঞ্জন রেডিও বাংলা নেটকে জানিয়েছিলেন, ‘দ্বিতীয় সিজ়ন অবশ্যই আসবে, তার গল্পও লেখা হয়ে গেছে। প্রথম সিজ়ন শুট করার সময়েই দ্বিতীয়টার গল্পের কথা মাথায় রেখেই এগিয়েছি। পরের গল্পটাও দার্জিলিংকে নিয়েই।’ দেখা যাক এবারের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে দ্বিতীয় সিজন সমাদৃত হতে পারে কিনা।

এমন আরো সংবাদ

সর্বশেষ বিনোদন