১৯৪১ সালে কবি নজরুল একদল প্রতিভাবান তরুণকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘বেঙ্গল টাইগার পিকচার্স’ নামে একটি সিনেমা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দিন, এস ওয়াজেদ আলী, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, হুমায়ূন কবীর, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আজিজুল ইসলাম, আজিজুল হক, সারওয়ার হোসেন প্রমুখ। তবে চলচ্চিত্র জগতে বিদ্রোহী কবি পা রেখেছিলেন আরো আগে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক মন্দা, সত্যাগ্রহ আন্দোলন, সুভাষচন্দ্রের উত্থান এবং ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানে উত্তাল উপমহাদেশ। কল্লোল যুগসহ বেশ কয়েকটি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর সদস্যরা সময়কে আরো শক্তভাবে ধরতে চলচ্চিত্রকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ও কাজী নজরুল ইসলাম তাদের অন্যতম। কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান নিয়ে তারা চলচ্চিত্রে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারপর একসময় চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা, নির্দেশনা ও অভিনয়ের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়লেন।
নজরুল বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে যোগ দিলেন চলচ্চিত্রে। তখন একদিকে নির্বাক চলচ্চিত্র ডুবছে, অন্যদিকে সবাক চলচ্চিত্রের উত্থান। তিনি এলেন এবং সাহিত্যের মতো এখানেও নিজের বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেন। তিনি চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখেছেন, সংগীত পরিচালন করেছেন, অভিনয় করেছেন, কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছেন—এমনকি চলচ্চিত্র পরিচালনও করেছেন।
কুড়ির দশকেই কবি নজরুল সংগীত ব্যক্তিত্ব হিসেবেও সুখ্যাত। আধুনিক গানের তিনিই তখন কাণ্ডারি। ত্রিশের দশকে তিনি ‘ম্যাডান থিয়েটার্স’-এ ‘সুরভাণ্ডারি’ হিসেবে যোগ দেন। তার দায়িত্ব ছিল অভিনয় শিল্পীদের কণ্ঠস্বর পরীক্ষা করা। ১৯৩০ সালের শেষের দিকে চলচ্চিত্র নির্দেশক হিসেবে ‘পাইওনিয়ার কোম্পানি’তে কাজ শুরু করেন। ১৯৩১ সালে ‘প্রহ্লাদ’ সিনেমায় সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘ধ্রুব’ (১৯৩৪) সিনেমায় শুধু গীতিকার, সংগীত পরিচালক ও সহনির্দেশক হিসেবে কাজ করেননি—নারদের ভূমিকায় অভিনয়ও করলেন নজরুল। এই সিনেমার ১৮টি গানের ১৭টিই তার লেখা। ‘নিউ থিয়েটার্স’ প্রযোজিত ১৯৩৭ সালের ‘বিদ্যাপতি’ সিনেমার কাহিনীকার নজরুল। ১৯৩৮ সালে আসে ‘গোরা’ সিনেমা। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস অবলম্বনে। এই সিনেমার সংগীতের দায়িত্ব পড়ে নজরুলের ওপর। ১৯৩৯ সালে তার কাহিনী অবলম্বনে আরো একটি সিনেমা মুক্তি পায়—‘সাপুড়ে’। এই সিনেমারও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘নিউ থিয়েটার্স’।
তাছাড়াও ১৯৩৫ সালের ‘পাতালপুরী’ ও ১৯৩৭-এর ‘গ্রহের ফের’ সিনেমায় সংগীত পরিচালক, ১৯৪১-এর ‘নন্দিনী’তে সুরকার, ১৯৪২-এর ‘চৌরঙ্গী’তে গীতিকার ও সংগীত পরিচালক এবং ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৯৩৩), ‘দিলখুশ’ (১৯৪৩), ‘শহর থেকে দূরে’ ও ‘অভিনয় নয়’ (১৯৪৫) সিনেমায় গীতিকার হিসেবে কাজ করেছেন জাতীয় কবি।
আজ ১২ ভাদ্র। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র তিনি রাজধানীর পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।