একটানা দর বৃদ্ধির পর কিছুটা শান্ত হয়ে আসছে কুইবেক তথা কানাডার রিয়েল এস্টেট মার্কেট। ক্রেতাদের জন্য স্বস্তিদায়ক মার্কেটের সাময়িক এই মন্থর অবস্থাকে বলা যায় অটো কারেকশন কিংবা বিগত ৩/৪ বছর ধরে মার্কেটের লাগামহীনভাবে টানা দরবৃদ্ধিতে একটু বিরতি। উল্লেখ্য, মার্কেটে এখনো বিডিং চলছে। মার্কেট প্রাইস কিংবা আস্কিং প্রাইসের অনেক উপরে এখনো বাড়ি বিক্রি হচ্ছে। তবে উত্তাপটা একটু কম। মাস দুয়েক আগে যেখানে কোন ভালো প্রোপার্টিতে ২০/২৫ টা অফার পড়তো, এরকম প্রোপার্টিতে এখন গড়ে ১০/১২ টা অফার পড়ছে। ফলে দামের ক্ষেত্রে উন্মত্ততা একটু কম পরিলক্ষিত হচ্ছে।
কিছুদিন আগেও একেবারে সাধারণ প্রোপার্টিগুলিতেও আস্কিং প্রাইস কিংবা কাছাকাছি প্রাইসে কেনার মতো লোকের অভাব ছিল না। এখন পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসছে। একেবারে টিপটপ প্রপার্টিগুলি ছাড়া সাধারণ প্রোপার্টিগুলিতে কেউ আর আগের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ছেনা। উপরন্তু ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া বন্ধ থাকাতে রেন্টাল মার্কেটের চাহিদা এখন একটু কম। এই সামারে রেন্টাল প্রোপার্টি থেকে নতুন কনস্ট্রাকশন গুলিতে অনেকে মুভ করেছেন, যেগুলিতে নতুন ভাড়াটিয়া দ্বারা পুরোপুরি প্রতিস্থাপন সম্ভবপর হয়নি। আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রেন্টাল মার্কেটের এই সংকট অব্যাহত থাকবে। কানাডার অভ্যন্তরে ৯০% জনগণের দুই ডোজ কোভিড ভ্যাকসিনেশন সম্পন্ন হলেই ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া যথারীতি শুরু হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে রেন্টাল মার্কেটে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
রিয়েল এস্টেট মার্কেটের সাম্প্রতিক হালচাল নিয়ে দুটো ব্যাপারে এখানে আলোকপাত করা প্রয়োজন। প্রথমত, ফেডারেল সরকার কর্তৃক জারিকৃত স্ট্রেস টেস্টের বিষয়টা ইদানীং জনমানুষের মুখে বেশ ঘুরপাক খাচ্ছে। এখানে একটা ব্যাপার জেনে রাখা প্রয়োজন যে সরকার কর্তৃক এরকম স্ট্রেস টেস্টের প্রয়োগ একেবারে নতুন কিছু নয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মত এটি প্রয়োগ করে বিভিন্ন সময়ে এডজাস্ট করা হয়| কিন্তু চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় এর প্রভাব মার্কেটে কখনো খুব একটা পড়েনি। গত ১ জুন থেকে কার্যকর নতুন স্ট্রেস টেস্টের যে প্রভাব মার্কেটে পড়েছে, সেটাও আসলে যতটা না বাস্তবিক, তার চাইতে বেশিই মনস্তাত্ত্বিক।
দ্বিতীয়ত, সেপ্টেম্বরে কোভিড সংক্রান্ত বেনিফিট বন্ধ হয়ে গেলে রিয়েল এস্টেট বাজারে ধ্বস নামবে কি না, এ নিয়েও মার্কেটে বেশ আলোচনাও চলছে। প্রকৃতপক্ষে রিয়েল এস্টেট মার্কেট স্টকমার্কেটের মতো নয় যে, এখানেও একই প্যাটার্নে ধ্বস আসবে। কুইবেকে বিগত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ১৯৯৮ এর ঐতিহাসিক তুষারঝড়-পরবর্তী সময়টা ছাড়া রিয়েল এস্টেটের দাম কখনো কমেনি। মাঝখানে দুয়েকবার যা মূল্যহ্রাস হয়েছে সেটাকে মার্কেট সংশোধন ছাড়া কিছু বলার অবকাশ নেই।
`
২০২০ সালের প্রথম দিকে যখন প্রথমবারের মতো কোভিড আতঙ্ক বিরাজ করছিলো, তখন মার্কেট পড়ে যাবে বলে একটা আওয়াজ শোনা গিয়েছিলো সংবাদ মাধ্যমে। অনেক বিশেষজ্ঞও আশংকা করেছিলেন রিয়েল এস্টেটের দাম ৩০%-৫০% এ নেমে আসবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। নিম্ন সুদের হার এবং অলস পড়ে থাকা টাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে একসাথে অনেক লোকের বাড়ি কেনায় ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণে ওই সময়টাতেই দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫-৩০%। অনেকে ভাবছেন রিয়েল এস্টেটের দাম ‘বাবল’ এর মতো বৃদ্ধি পেয়েছে বলে এর পতন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রিয়েল এস্টেটের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক এরকম না। সাম্প্রতিক ছন্দপতনকে বড়জোর কারেকশন বলা যেতে পারে, কোনোভাবেই ধ্বস বলার সুযোগ নেই, কারণ এটা স্টক নয় যে এখানে “স্টপ লস” এর মত কৌশল অবলম্বন করে ক্ষতিকে মিনিমাইজ করতে হবে। আবাসন মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর একটি। এখানে লাভ -ক্ষতির চেয়ে প্রয়োজনীয়তাটা মুখ্য। ক্ষতি ঠেকানোর জন্য স্টক বিক্রি করে দেয়া যায়, কিন্তু বাড়ি সে অর্থে বিক্রি করা যায় না। জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে এ রকম বিষয় ব্যতীত বাড়ি বিক্রি করে দেয়ার ব্যাপারটা সাধারণত কারো মাথায় আসেনা। তাই স্টক মার্কেটের মত রিয়েল এস্টেট মার্কেটে পতন আসবে, এমনটি হওয়ার মতো কোন কারণ নেই।
কানাডার উত্তপ্ত হাউজিং মার্কেটের পরিণতি যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৭/২০০৮ সালে সংগঠিত হাউজিং মার্কেট ধ্বসের মতো কিছু একটা হবে এমন আশংকাও প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু বস্তুতঃ ঐ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে যেটা ঘটেছিলো, সেটা ছিল অনেকটা সে সময়ের ত্ৰুটিপূর্ণ ব্যাঙ্কিংয়ের ক্যাজুয়ালিটি। তার বিপরীতে বলা যায় কানাডিয়ান ব্যাংকিং অনেক কঠোর নিয়মকানুনের উপর প্রতিষ্টিত। ব্যাংকিং সিস্টেমের ফাঁক ফোকর নিয়ে কোন রকমে একটি মর্টগেজ ম্যানেজ করে বাড়ি কেনা ফেলা এখন আর এতো সহজ নয়। ফেডারেল সরকার কর্তৃক জারিকৃত স্ট্রেস টেস্টের কল্যাণে মর্টগেজ তারাই পাচ্ছেন যারা সাময়িক বেকার সমস্যা কিংবা আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠে পিরিয়ডিক ইনস্টলমেন্ট চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য রাখেন। যার ফলে ব্যাংক কর্তৃক পজেশন নিয়ে নেয়া বাড়ির সংখ্যা খুবই নগন্য যা মার্কেটকে অব্যাহতভাবে স্থিতিশীল রাখছে।
হাউজিং মার্কেটের অতি সাম্প্রতিক এই মন্থর দশা খুব বেশি দীর্ঘ হবার কথা না। ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হলেই রেন্টাল মার্কেট আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কারেক্টেড মার্কেটে সেসাথে স্ট্রেস টেস্টের চাপটাও কেটে যাবে কিংবা কম অনুভূত হবে। শ্লথগতিপ্রাপ্ত রিয়েল এস্টেট মার্কেটের আগের অবস্থায় প্রত্যাবর্তন যে সময়ের ব্যাপার মাত্র, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
লেখক : প্রকৌশলী শিহাব উদ্দিন, রিয়েল এস্টেট ব্রোকার , realtor.shihab@gmail.com