সুচিত্রা সেনকে বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি বলা বেশি যৌক্তিক। তাকে নিয়ে যত গল্প, যত গুজব এবং কানাঘুষা আছে তত খুব কম তারকাকে নিয়েই আছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। কোথাও নেই বয়স্ক সুচিত্রার ছবি! চিরসবুজ সুচিত্রাই সবার মনে গাঁথা। অনেকে বলেন, জনসম্মুখে আসতে হবে বলে ২০০৫ সালে তিনি ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’ গ্রহণ করেননি!
শুধুই কি বাংলা সিনেমা! নিজের অনন্য অভিনয় ও রূপ-লাবণ্যের ছাপ তিনি রেখেছেন বলিউড সিনেমায়ও। তিনি বাংলা থেকে হিন্দি সিনেমায় এসেছেন শক্তিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা বিমল রায়ের হাত ধরে। ব্লকবাস্টার ‘দেবদাস’ (১৯৫৫) সিনেমায় তখনকার সুপারস্টার দিলীপ কুমার ও বৈজয়ন্তী মালার সঙ্গে কাজ করেছেন। তারপর মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন দেব আনন্দের বিপরীতে ‘বোম্বাই বাবু’ চলচ্চিত্রে। তার অভিনীত আরো একটি বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা ‘আন্ধি’। একজন নারী রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনের ওপর ভিত্তি করে সিনেমাটি তৈরি করেছিলেন গুলজার। বলা হয়ে থাকে সিনেমাটি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত। এই সিনেমার ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে’ গানটি এখনো মানুষের মুখে মুখে।
বাংলা ও হিন্দি সিনেমার বহু মহারথীর নজর কাড়তে পেরেছিলেন সুচিত্রা। কিন্তু সেসময়ের প্রখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক—সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনের ছবিতে সুচিত্রার কাজ করা হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবী চৌধুরানী’ অবলম্বনে ষাটের দশকে সত্যজিৎ একটি সিনেমা করার কথা ভাবছিলেন। চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে সুচিত্রা অভিনয় করুক। তিনি সুচিত্রাকে শর্ত দিয়েছিলেন, ‘দেবী চৌধুরানী’ সিনেমায় কাজ করার সময় সুচিত্রা অন্যকোনো সিনেমায় কাজ করতে পারবেন না। ‘মহানায়িকা’ সেই শর্ত মানতে রাজি হননি, কাজও আর এগোয়নি।
অন্যদিকে ‘শোম্যান’ রাজ কাপুরের সিনেমা নিজেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সুচিত্রা। রাজ কাপুর সিনেমার প্রস্তাব নিয়ে নিজেই সুচিত্রা সেনের কলকাতার বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন। ‘আওয়ারা’র হাতে ছিল ফুলের তোড়া। কিন্তু সুচিত্রা সেনের মন গলেনি। তিনি বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সেই প্রস্তাব। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, সুচিত্রা রাজ কাপুরের ‘ফিল্মি’ স্টাইল পছন্দ করেননি। প্রস্তাব ফিরেয়ে দেয়ার পর কাছের একজনকে সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘একজন পুরুষকে কেন নারীর সামনে নত হয়ে অভিবাদন জানাতে হবে?’
১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার অর্জন করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তিনি ১৯৭২ সালে ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ এবং ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘বঙ্গবিভূষণ’ পদক গ্রহণ করেন। আর জাতীয় চলচ্চিত্র এবং ফিল্মফেয়ার পুরস্কার কখনো তার ভাগ্যে জোটেনি। তার মেয়ে মুনমুন সেন এবং নাতনি রিয়া ও রাইমা সেনও অভিনয়শিল্পী।