এমন কিছু দৃশ্য থাকে যেগুলো আমাদের সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। ২০১৭ সনের ৮ জুলাই অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন গঠিত হয়, এই তো ঢাকার শাহজাদপুরে। শুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় যারা প্রাণ হারান তাদেরই একজন হাস্যোজ্জ্বল অবিন্তা কবির। ফাউন্ডেশন উদ্বোধনের দিন সাংবাদিক হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ যখন কথা বলতে পোডিয়ামে ওঠেন তখন আমিও অনেকের মতো কান্না ধরে রাখতে পারিনি। রুবা আহমেদ কথা বলতে পারছিলেন না, একটি শব্দও না। সেদিন তার অশ্রুই তার ভাষা হয়ে উঠেছিল।
তখন রুবা আহমেদ আদরের সন্তানের স্মৃতি পাথেয় করে শোক মোকাবেলা করছিলেন। তখনো তিনি জানেন না, ভবিষ্যতে তাকে একটি সিনেমা প্রতিহত করার লড়াইয়ে নামতে হবে। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে সেই জঙ্গি হামলা নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘ফারাজ’-এর ট্রেলার। ঘোষণা এসেছে সিনেমা আসছে ৩ ফেব্রুয়ারি। ২০১৯ সন থেকে এই সিনেমার বিরোধিতা করে আসছে অবিন্তা পরিবার। প্রথম দিকে হয়তো তারা ভেবেছিলেন একজন মায়ের আবেগকে শ্রদ্ধা জানিয়েই ফারাজ পরিবার এই সিনেমা করা থেকে সরে আসবে। তা হয়নি। রুবা আহমেদকে দিল্লির আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) সাংবাদিকদের সামনে এসেছিলেন রুবা আহমেদ। এবিষয়ে আগে কখনো তাকে সামনে আসতে দেখা যায়নি। এবার তিনি এসেছেন একজন মা হিসেবে। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা থেকে শুরু করে দিল্লির হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ানো—সবটাই বললেন তিনি। শেষে তার অসহায়ত্ব প্রকাশ পায় ‘আমি জানি, হয়তো আমি কিছু করতে পারবো না’ বাক্যেটিতে। তার কষ্ট, কেউ তার আবেগকে নূন্যতম সম্মান দেখালো না। একজন মায়ের ভালোবাসাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বাজারে আসছে ‘ফারাজ’। সিনেমাটি দেখার সুযোগ করে দেয়া তো দূরের কথা সিনেমা তৈরিতে তাদের সম্মতিও নেয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন তিনি। এর পাল্টা কোনো বক্তব্য থাকলে ফারাজ পরিবার দিক। না, কখনো এবিষয়ে কথার বলার প্রয়োজন মনে করেনি তারা।
রুবা আহমেদর চান না এই সিনেমায় অবিন্তাকে মূর্ত করা হোক, সে রাতের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পুনরুৎপাদন দেখতে তার আপত্তি। তিনি শঙ্কিত তার কন্যার ও তার প্রাইভেসি নিয়ে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ফারাজ তার কন্যা অবিন্তার জন্য জীবন দিয়েছে তা তিনি বিশ্বাস করেন না। কেননা এই ন্যারেটিভের পেছনে কোনো যুক্তি বা প্রমাণ নেই। না আছে কোনো সাক্ষী।
রুবা আহমেদর এই কথাটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ফারাজ হিরো, জঙ্গিরা তাকে ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু সে তার দুই বন্ধু—অবিন্তা ও তারিশির জন্য রয়ে যায় এবং প্রাণ হারায়। এই যে ন্যারেটিভ—তার ভিত্তি কি? বলা হচ্ছে ‘ফারাজ’ সিনেমাটির অন্যতম ভিত্তি সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবুর লেখা ‘হোলি আর্টিজান : একটি জার্নালিস্টিক অনুসন্ধান’ শিরোনামের বই। চলুন দেখি ফারাজের ‘বীরত্ব’ সম্পর্কে সেই বই কি বলছে,
‘ফারাজ অবিন্তা ও তারিশি জৈনকে সকালের দিকে হত্যা করা হয় বলে একাধিক গণমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। ফারাজের নিকটাত্মীয় হিশাম হোসাইনের বরাত দিয়ে ২ জুলাই ২০১৬ তারিখে নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে হিশাম হোসাইন বলেন, ফারাজকে জঙ্গিরা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল এবং তিনি দুই বান্ধবীকে ছেড়ে আসতে চাননি বলে তাকে তাকে হত্যা করা হয়। তবে অনুসন্ধানে এরকম কোনো তথ্যের সত্যতা মেলেনি। প্রকৃতপক্ষে রাত সাড়ে ১২টার থেকে ১টার পর কাউকে হত্যার ঘটনা কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বলতে পারেননি। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারাও প্রত্যক্ষদর্শীদের যে জবানবন্দি নিয়েছেন তাতে এমন কোনো ঘটনার কথা উল্লেখ নেই। সিটির (কাউন্টার টেরোরিজম) প্রধান মনিরুল ইসলাম আমাকে বলেছেন, এখন পর্যন্ত তাদের তদন্তে ফারাজকে জঙ্গিদের ছেড়ে দেওয়ার কোনো ঘটনার কথা কেউ বলতে পারেনি।’
যে বই অবলম্বনে এই সিনেমা, সে বইয়ের ভাষ্যের বিপরীত সিনেমার গল্প! পুরো সিনেমাই তো ফারাজকে কেন্দ্র করে। তার ‘বীরত্ব’কে প্রতিষ্ঠা করার হাতিয়ার এই ‘ফারাজ’। যদিও কেউ জানে না ওই সময় ফারাজ, অবিন্তা ও তারিশির সঙ্গে ঠিক কি ঘটেছিল। এই বীরত্বসুলভ ন্যারেটিভ তাহলে কোত্থেকে এলো? কে এই হিশাম হোসাইন? তাকে আর পাওয়া যায়নি—একটি বারের জন্যও না। ফারাজ পরিবারের মালিকানাধীন পত্রিকা প্রথম আলো নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ওই একটি মাত্র প্রতিবেদনের ওপর ভর করে সাংবাদিকতার নামে একটি কল্পকাহিনী প্রচার করে যাচ্ছে। প্রথম আলো কখনো ওই হিশাম হোসাইনকে সামনে আনেনি, তার বক্তব্য নেয়নি। তারা এতো এতো সাক্ষাৎকার নেয়, হিশামের সাক্ষাৎকার নিলো না। প্রথম আলোয় কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, মালিকপক্ষের বলেই প্রথম আলো এমন ভিত্তিহীন সূত্র নির্ভর কাহিনীকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উড়াচ্ছে। তাতে যোগ দিয়েছেন বা যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন প্রথম আলোর বাঘা বাঘা সাংবাদিক ও লেখক।
প্রশ্ন হলো, সেদিনের নৃশংস জঙ্গি হামলায় মোট ২২ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ফারাজকেই ‘হিরো’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো কেন? কারণ, হামলার দিন থেকেই অভিযোগ ওঠে ফারাজ নিজেও জঙ্গি। একটি মহল তাকে হামলাকারীদের একজন হিসেবে প্রচার করা শুরু করে। এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ফারাজের জঙ্গি হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবুও এই অভিযোগটি সেসময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এই মাথা কেটে দিতেই পাল্টা একটি ন্যারেটিভের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখনই হাজির করা হয় ফারাজের সাহসিকতার তত্ত্ব। প্রবর্তিত হয় ‘ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার’। তারই ধারাবাহিকতায় ‘ফারাজ’ সিনেমা।
আমি মনে করি, ইতিহাস নির্মোহ। আপনার মনে হতে পারে আপনি ইতিহাস নিয়ে খেলতে পারেন, এই ধারণাটা ভুল। কেননা, আপনি যে খেলছেন একসময় ইতিহাস তাও বলে দেয়। আমি আরো মনে করি, ইতিহাসের পাতায় ফারাজকে আরোপ করার মরিয়া চেষ্টা হিতে বিপরীত হবে। আরোপের ফলে ফারাজ চিরকাল বিতর্কের বৃত্তে আবর্তিত হতে থাকবে।
লেখক: দৃশ্যগল্পকার