গত ৫ ডিসেম্বর রাতে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের সঙ্গে ঢালিউড অভিনেত্রী মাহির পুরোনো একটি কথোপকথন ফাঁস হয়। দুই বছর আগের এই ফোনকলে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় মাহিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে তুলে এনে ধর্ষণের হুমকি দেন মুরাদ। এই কথোপকথনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিনোদন অঙ্গনে তোলপাড় চলছে। আজ (৭ ডিসেম্বর) ই-মেইলের মাধ্যমে ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে মন্ত্রিপরিষদে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন মুরাদ।
এর আগে গত সপ্তাহে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, তারেক রহমান ও তার কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেন মুরাদ। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তির এমন কর্মকাণ্ডে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, এমন দ্বিমুখিতার সমালোচনা করেছেন। মুরাদের নাম সরাসরি উল্লেখ না করে ফারুকী বলেন, “আগের দিন দেখলাম প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নাতনীকে নিয়ে অশ্লীলতম ভাষায় প্রজাতন্ত্রের একজন চাকর কথা বললেন।তার পরদিন সেই একই লোক এক অনুষ্ঠানে গিয়ে পুলিশ ভাইদের নসিহত করলেন যাতে তারা কারো সাথে ব্যবহার খারাপ না করেন। তার পরদিন শুনলাম উনি রেপ করার থ্রেট দিচ্ছেন কাউকে।’’
ফারুকী প্রশ্ন করেছেন, ‘‘এমন দেশটি কোথায় খুঁজে পাবেন?‘’’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘‘এইসব দেখিয়া শুনিয়া একজন নাগরিক হিসাবে আমি যার পর নাই ক্ষুব্ধ। আমি বিশ্বাস করতে চাই মন্ত্রীসভার অন্য সদস্যরাও এই লোকের সাথে এক টেবিলে বসতে লজ্জাই বোধ করবেন। এই ছোট্ট জীবনে আমার সুযোগ হইছে দুয়েকজন মন্ত্রী দেখার। তাদের কারো কারো প্রশংসা করে আমি লিখছিলামও। আমি বিশ্বাস করি তারা কেউই চাইবেন না এই লোক তাদের বিজ্ঞাপন হয়ে উঠুক।’’
আজ ই-মেইলের মাধ্যমে ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে মন্ত্রিপরিষদে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন মুরাদ, এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘ক্ষমা চেয়ে’ একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে মুরাদ বলেন, “আমি যদি কোন ভুল করে থাকি অথবা আমার কথায় মা-বোনদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মমতাময়ী মা দেশরত্ন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সব সিদ্ধান্ত মেনে নেবো আজীবন।’’
৪ ডিসেম্বর টিভি টকশোতে আলোচনার এক পর্যায়ে বিএনপি নেত্রী সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়াকে বলেন ‘মানসিক রোগে আক্রান্ত’। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে এবং জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী মৌসুমীর ওজন নিয়ে একাধিকবার আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মুরাদ বলেন, তার যেসব ‘নারীবিদ্বেষী’ বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, তা ভুল বলে স্বীকার করে নেয়া বা প্রত্যাহার করার ‘প্রশ্নই ওঠে না’। তার দাবি, দল বা সরকারের পক্ষ থেকে তার এসব বক্তব্য প্রত্যাহারের জন্য কোনো চাপ নেই—বরং তিনি যা করছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই করছেন।
পেশায় চিকিৎসক মুরাদ ২০০৮ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে জামালপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমে বইমেলায় গাড়ি নিয়ে ঢুকে বিতর্কিত হন তিনি। এরপর স্কয়ার হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগে মাত্র ৫ মাসের মাথায় তাকে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদে স্থানান্তর করা হয়।
১০ অক্টোবর ১৯৭৪ সালে জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলাধীন দৌলতপুর গ্রামে মুরাদ হাসান জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী বিচারপতি এবং জেলা আওয়ামী লীগ ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ছিলেন। ১৯৯০ সালে মুরাদ জামালপুর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৯৩ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০০০ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ছাত্রজীবনে তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, এরও আগে ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক পদে ছিলেন মুরাদ।
২০০৪-২০০৫ সালে মুরাদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ‘প্লাস্টিক ও পুনর্গঠনমূলক সার্জারি’র ওপর স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন, এবং ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকিরণ ক্যান্সারবিজ্ঞানের ওপর এম. ফিল ডিগ্রী নেন। বর্তমানে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্সারবিজ্ঞান বিভাগে পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন মুরাদ। এছাড়াও তিনি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এবং একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য। তিনি স্বাচিপ এবং বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর আজীবন সদস্যপদেও তিনি অধিষ্ঠিত আছেন। মুরাদের শিষ্টাচারবর্জিত আচরণের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান এবং তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি এখনো আসেনি।