ঋত্বিক প্রতিভার উজ্জ্বল নিদর্শন ‘অযান্ত্রিক’

 

৪ নভেম্বর চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে

রিয়ালিজম হলো বাস্তববাদ, আর ম্যাজিক রিয়ালিজম এমন এক জায়গা যেখানে অবাস্তব ও বাস্তব মিলেমিশে একাকার। জাদুবাস্তববাদে জাদুটা খুবই সাধারণভাবেই ঘটে। এই অবাস্তব ঘটনা দেখে পাঠক বা দর্শক অবাক হন না, তারা এই ঘটনাকে বাস্তবের অংশ বলেই ধরে নেন। এজন্য এটি শুধু জাদু বা ফ্যান্টাসি নয়—ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তববাদ। শিল্পসাহিত্যে এই মতবাদের উদ্ভব মূলত বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে। আর বিকাশ পঞ্চাশের দশকে।

চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক শিল্পসাহিত্যে ‘লেবেলিং’-এর বিরোধী ছিলেন। তাকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল—তার দ্বিতীয় সিনেমা ‘অযান্ত্রিক’ নব্য-বাস্তববাদের (নিও-রিয়ালিজম) ফসল কিনা। তখন তিনি তার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘“অযান্ত্রিক” কমপ্লিটলি একটা ফ্যান্টাস্টিক রিয়ালিজম, একটা কার—একটা গাড়ি উইদাউট এনি ট্রিক শট ওটাকে এনিমেট করা হয়েছে। শি ইজ দ্য হিরোইন, আর ড্রাইভার হচ্ছে হিরো। হোল গল্পটা একটা ড্রাইভার আর তার গাড়ি। আর কিছুই নেই। এটার সঙ্গে নিও-রিয়ালিজমের সম্পর্ক কি?” (মুহম্মদ খসরুর নেয়া সাক্ষাৎকার, ১৯৭৭) 

‘অযান্ত্রিক’-এর পোস্টার

ঢকঢক করে গাড়ির পানি খাওয়া, পানি পান শেষে তৃপ্তি প্রকাশ করা, হেডলাইটগুলোর নড়াচড়া, রাগ করে থেমে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনা খুবই সহজভাবে ঘটে চলে। অনেক দর্শক হয়তো টেরও পান না। অনেক সময় আমরা গাড়িটিকে দেখি ঠিকই—কিন্তু অবচেতনে তাকে একটি মানবিক সত্ত্বা হিসেবে ধরে নিই। মনে হয় না যন্ত্র এসব করছে। এসব দেখেশুনে বিস্মিতও হই না। এজন্যই ঋত্বিক ‘অযান্ত্রিক’কে ফ্যান্টাস্টিক রিয়ালিজম বলেছেন। আর সম্ভবত তিনি ‘ফ্যান্টাস্টিক রিয়ালিজম’ বলতে ওই জাদুবাস্তববাদই বুঝিয়েছিলেন।

১৯৫৮ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটিতে প্রধানত দুটি চরিত্র—গাড়িচালক বিমল এবং তার লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি ‘জগদ্দল’। কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটি মুক্তির দিক থেকে ঋত্বিকের প্রথম কাজ। গাড়ি ও গাড়িচালকের মধ্যকার একটি মানবিক সম্পর্ক এবং সম্পর্কের পরিণতি এই সিনেমার মূল উপজীব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিপর্যস্ত ও নিঃসঙ্গ মানুষের কাছে কিভাবে যন্ত্রই হয়ে ওঠে অযান্ত্রিক, মানবিক—তাই দেখানো হয়েছে এই সিনেমায়। ১৯৫৭ সালে স্ত্রী সুরমা ঘটককে লেখা এক চিঠিতে ঋত্বিক বলছেন, ‘“অযান্ত্রিক”-এর মেইন থিম মৌল উপজীব্য ছিল একটাই। যাকে আমরা “দ্য ল অফ লাইফ”; জীবনের নিয়ম বলতে পারি। পাগলের নতুন গামলা পেয়ে পুরোনোটি ভুলে যাওয়ার সেই নিষ্ঠুর দৃশ্য এবং সর্বশেষ এক শিশুর হাতে জগদ্দলের ক্রেংকার ধ্বনি, যাতে বিমলকে উপলব্ধির হাসিতে ভুলিয়ে দিয়েছিল—এগুলোতে সেই কথাই প্রকাশ করেছে। এ যেন ভ্যারিয়েশন অন এ মাইনর স্কেল অব দ্য মেইন থিম, এ সর্ট অব ইকো, যা যেকোনো সিম্ফোনিক স্ট্রাকচারের প্রাণবস্তু।’
‘অযান্ত্রিক’-এর একটি দৃশ্য
‘অযান্ত্রিক’ একই সঙ্গে হাসির ও বেদনার। সিনেমার গোড়া থেকে মাঝখান পর্যন্ত হাসির খোরাক, তারপর থেকে শেষটুকু দুঃখবোধ জাগায়। এমন বিষয়বস্তু বাংলা সিনেমায় এর আগে দেখা যায়নি। দর্শকদের নতুন এক অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল এই সিনেমা। মনে হয়, ঋত্বিক যদি শুধুমাত্র ‘অযান্ত্রিক’ই তৈরি করতেন তাহলেও তিনি ইতিহাসে টিকে থাকতেন। এমন বিষয়বস্তু, গভীর বার্তা ও  নান্দনিকতা সেসময় শুধু ভারতবর্ষেই নয়—গোটা বিশ্বেও বিরল ছিল। এধরনের সিনামা তৈরির কারণ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘আমি কোনো সময়ে একটা সাধারণ পুতুপুতু মার্কা গল্প বলি না যে, একটি ছেলে একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে প্রথমে মিলতে পারছে না, তাই দুঃখ পাচ্ছে, পরে মিলে গেলো বা একজন পটল তুললো এমন বস্তাপচা সাজানো গল্প লিখে বা ছবি করে নির্বোধ দর্শকদের খুব হাসিয়ে বা কাঁদিয়ে ঐ গল্পের মধ্যেও ইনভলভ করিয়ে দিলাম।…এরমধ্যে আমি নেই। আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাবো যে, ইট ইজ নট এ ইমাজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি।’
বিমল চরিত্রে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়
সুরমা ঘটকের ‘ঋত্বিক’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এই অতুলনীয় সিনেমাটি সেসময় ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়নি। আমার ধারণা, আমাদের দর্শক সিনেমায় এই নতুন দর্শন ও আঙ্গিক গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। ‘অযান্ত্রিক’ তার সময় থেকে অনেক এগিয়ে ছিলো। ‘অযান্ত্রিক’ সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় বলেছেন, ‘যে সমস্ত গুণগুলো থাকলে একটা ছবি সত্যিকারের সার্থকতা অর্জন করতে পারে সেই ধরনের চলচ্চিত্রের কতকগুলি বিশেষ গুণ “অযান্ত্রিক’-এ প্রায়ই বহু জায়গায় লক্ষ করা যায়।…বিশেষ করে কতকগুলি শট, যেখানে ঘটনা হয়তো কিছুই ঘটছে না, উপাদান সামান্যই। কিন্তু একটা বিশেষ কনটেক্সটে এসে সেই শট এমন একটা কাব্যের  পর্যায়ে উঠে গেছে, এমন শক্তিশালী চেহারা নিয়েছে যেটা একমাত্র অত্যন্ত শক্তিশালী পরিচালকের পক্ষেই সম্ভব।’ (ঋত্বিক ঘটক, ১৯৭৬)
ঋত্বিক ঘটক

আর নাট্যব্যক্তিত্ব ও চলচ্চিত্র নির্মাতা পার্থপ্রতিম চৌধুরীর মতে, ‘ঋত্বিক প্রতিভার মহৎ উন্মেষ “অযান্ত্রিক”। “অযান্ত্রিক” ছবির শিল্পচিন্তায় প্রায় সর্বত্রই সিনেমার এক নতুন ভাষা কাজ করেছে যা “পথের পাঁচালী”র বিস্ময়কর সাফল্যে চিহ্নিত না হয়েও স্বতন্ত্র। “অযান্ত্রিক” সিনেমার ভাষা রোমান্টিক নয়; তথাকথিত সিনেম্যাটিক নয়, লিরিক্যাল নয়, অ্যানালজিক্যাল নয়, এসব থেকে আলাদা হয়েও বিশিষ্ট।’ (ঋত্বিক ঘটক রেট্রোস্পেক্টিভ, ২০১৬)

ক্যারিয়ারের গোড়ার দিকে কাজের সুবিধার্থে একটি মোটরসাইকেল কিনেছিলাম। দামে সস্তা এবং অজনপ্রিয় ব্র্যান্ড। কোম্পানির নাম ছিল ‘হাবিব’। আমরা সবাই মোটরসাইকেলটিকে ‘হাবিব ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। ‘হাবিব ভাই’ আমার সঙ্গে ছিল চার থেকে পাঁচ বছর। রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে কখনো আমার সঙ্গ ছাড়েনি সে। হুট করে বন্ধ হয়ে আমাকে বিপদে ফেলেনি। তেল থাকলেই হলো—পথচলা থেমে নেই। খুব যত্ন করতাম। জীবন-সংগ্রামের দিনগুলোতে ‘হাবিব ভাই’ আমার খুব আপনজন হয়ে উঠেছিল। একজন আরেকজনের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে উঠেছিলাম। আমার পরিচিতরাও তা বুঝতো। পরে নতুন অফিস থেকে যখন নতুন মোটরসাইকেল দিলো—তখন বাধ্য হয়েই ‘হাবিব ভাই’কে বিক্রি করে দিতে হলো, টাকারও প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু এখনো ও যন্ত্রটাকে আমি মনে রেখেছি। তার প্রতিটি ধাতব অংশ আমার চোখে ভাসে। ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’ দেখার সময় আমার নিজেকে বিমল আর জগদ্দলকে ‘হাবিব ভাই’ মনে হয়েছে। জড়বস্তুর সঙ্গেও ভালোবাসার সম্পর্ক হয়, সে এক পরাবাস্তব অভিজ্ঞতা।

ঋত্বিক যে অনন্য তার স্বাক্ষর তিনি তার প্রতিটি শিল্পকর্মে রেখেছেন। বিশেষ করে ‘অযান্ত্রিক’-এ তিনি যে নিজস্বতার নিদর্শন রেখেছেন—তা চিরস্মরণীয় ও অনুসরণীয়। পঞ্চাশের দশকের ‘অযান্ত্রিক’ আজো নতুন ও প্রাসঙ্গিক। সত্যজিৎও স্বীকার করেছেন, ‘ঋত্বিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য তাঁর মৌলিকতা এবং সেটা সে শেষ পর্যন্ত বজায় রেখেছিল।…ঋত্বিক মনেপ্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল—আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি।’

সুদীপ্ত সালাম দৃশ্যগল্পকার ও লেখক

 

এমন আরো সংবাদ

সর্বশেষ বিনোদন