হানিফ কুরাইশি মূলত একজন ঔপন্যাসিক, তাছাড়াও তিনি নাট্যকার এবং ব্রিটেনের পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রনাট্যকার। তার বাবা ছিলেন পাকিস্তানি, মা ব্রিটিশ। তার বয়স যখন পঁচিশ তখন তার প্রথম নাটক ‘দ্য কিং এন্ড মি’ (১৯৭৯) লন্ডনে মঞ্চস্থ হয়। লন্ডনের রয়াল কোর্ট থিয়েটারের স্থায়ী নাট্যকার হিসেবে যোগ দেন ১৯৮২ সালে। প্রথম লেখা চিত্রনাট্য ‘মাই বিউটিফুল লনড্রেট’-এর (১৯৮৬) জন্য অর্জন করেন ‘নিউইয়র্ক সেরা চিত্রনাট্য পুরস্কার’ এবং তা অস্কারের জন্য মনোনয়ন পায়। তার আরেক আলোচিত চিত্রনাট্য ‘ভেনাস’। তার প্রথম উপন্যাস ‘বুদ্ধা অফ সুবুরবিয়া’ প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। উপন্যাসটি লেখককে এনে দেয় ‘হোয়াইটব্রেড পুরস্কার’। তার সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস ‘সামথিং টু টেল ইউ’। ‘এমিরেটস্’-এর ওপেন স্কাইজ ম্যাগাজিনের নভেম্বর (২০০৮) সংখ্যায় দেয়া হানিফ কুরাইশির সাক্ষাৎকারের অনুবাদ এটি।
‘সামথিং টু টেল ইউ’ লিখতে আপনার কত দিন লেগেছিল?
এটা ছিল একটি দুঃসহ অভিজ্ঞতা। আমার এক বছর লেগেছে বইটি শেষ করতে। এতোদিন লাগার অবশ্য আরেকটি কারণ আছে। আমি একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করি। যেমন আমি তখন একই সঙ্গে ‘দ্য মাদার’ ও ‘ভেনাস’ ছবির কাজ করছিলাম।
উপন্যাসের বিষয়বস্তু কি?
এটি জনৈক জামাল খানের গল্প। একজন মনোবিশ্লেষক—যিনি তার জীবনের পঞ্চাশ বছরের ত্রিশ বছরই কাটিয়েছেন লন্ডনে।
আপনি কি উপন্যাস লেখার চেয়ে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
চিত্রনাট্য হয় ছোট এবং দ্রুত লেখা যায়। ৮০ থেকে ৯০ পৃষ্ঠার মধ্যে শেষ। এতে আয়ও ভাল হয়। মনে রাখতে হবে আমাকেও জীবনধারণ করতে হয়। যাহোক, অন্যদিকে উপন্যাস হলো একাকী করার মতো কাজ। চিত্রনাট্যে সেরকম কিছু নেই। চিত্রনাট্য উপলক্ষে আপনার সঙ্গে চলচ্চিত্র তারকাদের যোগাযোগ স্থাপন হয়, সামাজিকতা রক্ষা হয়। আর কি চাই! উপন্যাসের মাধ্যমে আপনি পাঠকদের দেখতে পান না, কিন্তু চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আপনি সিনেমা হলে গিয়ে দেখতে পারেন—দর্শকেরা আপনার নির্মিত শিল্পকর্ম মুগ্ধ হয়ে দেখছে। এ এক চমৎকার অনুভূতি।
সামথিং টু টেল ইউ লেখার শুরুটা কিভাবে?
সম্ভবত আমার এক মনোবিশ্লেষক চাচা এ উপন্যাসটি লেখার ক্ষেত্রে আমাকে তাড়িত করেছে। তিনি ফ্রয়েড দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। একদিন তিনি আমাকে বললেন, আমি নাকি ঈডিপাস কমপ্লেক্সে (প্রধানত যৌন বিষয়ে পিতার সঙ্গে পুত্রের অবচেতন শত্রুতা) ভুগছি । তখন আমি গভীরভাবে ফ্রয়েড-চর্চা শুরু করি এবং বুঝতে পারি একজন মনোবিশ্লেষক আর একজন লেখকের মধ্যে খুব বেশি তফাৎ নেই। উভয়ই চায় অন্যের আচার-আচরণ সম্বন্ধে জানতে, একজন পুরুষ কি চিন্তা করেন, একজন নারীর ভাবনা কি অথবা মানুষ বৃদ্ধ হলে কি অনুভূতি জন্মায় তা জানতে চায়।
আপনার লেখাগুলো কি জীবনীভিত্তিক?
সচারাচর তা-ই। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলি, আমি যখন পঞ্চাশে পৌঁছালাম তখন থেকে বৃদ্ধ হওয়া বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। একদিন আমি আমার মার সাথে একটি ভারতীয় রেস্টুরেন্টে বসেছিলাম। আমার মা এক ভারতীয় ওয়েটারের হাত ছুঁয়ে বললেন, তোমার হাত খুব সুন্দর। আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা দৃষ্টিকটূ হলো’। এ মন্তব্যে মার জবাব আমাকে ভাবিয়েছে। তিনি বললেন, বৃদ্ধ হলে কেমন লাগে তুমি জানো না, যখন বৃদ্ধ হবে—তখন দেখবে কেউ তোমাকে কখনো ছোঁবে না। এভাবেই আমার ‘দ্য মাদার’-এর জন্ম।
আপনি কি ছোটগল্পও লেখেন?
আমি ছোটগল্প লিখতে ভালোবাসি—কিন্তু মানুষ এখন আর তা পড়তে চায় না। আর ছোটগল্পে তেমন আয়ও হয় না।
লেখালেখি কি শেখানো যায়, এটা কি শেখানোর মতো বিষয়?
আমি লেখালেখির ক্লাস করিয়েছি। তা ছিল একটি বাজে ও ব্যর্থ চেষ্টা। যাক, সে অন্য কথা, কিন্তু আমি সাধারণত মনে করি, লেখালেখি শেখানো যায়। মনে করুন, আমি এক ছাত্রের গল্প পড়লাম, পড়ে দেখলাম গল্পটি যেখান থেকে শুরু হওয়ার কথা সেখান থেকে শুরু হয়নি, আমি তাকে তা বললাম। বিপজ্জনক কথা হলো, ছাত্ররা লিখছে আমাকে খুশি করার জন্য, তারা অনুভব করে না যে লেখাটি তার। ফুটবলার বেকহামকে তার কোচ বলল, ফ্রিকিক এভাবে কিংবা ওভাবে কর। লেখাও এভাবে শেখানো যেতে পারে। এর বেশি কিছু নয়। ফুটবল, ভায়োলিন ও নৃত্য শিখতে পারলে, লেখা কেন শেখা যাবে না?
আপনার লেখার সাথে আপনার পরিবারের সম্পর্ক কেমন?
আমি আমার বাচ্চাদেরকে বলি, তোমাদের বয়স সত্তর কি আশিতে পৌঁছানো পর্যন্ত আমার লেখা তোমাদেরকে তাড়া করবে। এরকম বিষয় নিয়ে আমরা গম্ভীরভাবে আলোচনা করে থাকি। আমার বাবার অপ্রকাশিত লেখাগুলো আমি পড়ি, লেখাগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আমি আমার বাবাকে নিয়ে একটি লেখা লিখেছি (মাই ইয়ার এট হিজ হার্ট), তাকে ভুলে থাকতে এই লেখা আমাকে সাহায্য করে। মাঝে মধ্যে আমার বাচ্চারা আমাকে প্রশ্ন করে, সংস্কৃতবান হওয়া কেনো জরুরি? প্রদর্শনী দেখতে যাওয়া কিংবা চিরায়ত বই পড়া কেনো প্রয়োজন? সুখী হতে, জীবন উপভোগ করতে এবং সফল হতে এগুলো সত্যিই কি তোমাকে সাহায্য করে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।
‘সামথিং টু টেল ইউ’তে ধর্মীয় মৌলবাদের কথাও উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি?
আজকাল ধর্মীয় মৌলবাদ আর বিংশ শতাব্দীর কমিউনিজম, ট্রটস্কিবাদ (রাশিয়ান বিপ্লবী নেতা লিয়ন ট্রটস্কির মতবাদ) অথবা মার্কসবাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আজ তাকে পাগল বলি যে নিজের জীবনকে কারো জন্য উৎসর্গ করলো । এ ব্যাপারটি কিন্তু বিংশ শতাব্দীর ভাববাদীদের কাছে পাগলামি ছিল না। যাহোক, ধর্মকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা খুবই অনুচিত।
আর কি লেখার কথা ভাবছেন?
জাতিগত বৈষম্য, যৌনতা, প্রৌঢ়ত্ব, বৃদ্ধ হওয়া ও মৌলবাদ নিয়ে লেখার পর আমি লেখার জন্য নতুন আইডিয়া খুঁজছি। আপনার কাছে কি নতুন আইডিয়া আছে?
প্রথম প্রকাশ : সাপ্তাহিক ২০০০, ২৩ জানুয়ারি, ২০০৯, বর্ষ ১১, সংখ্যা ২৭