রবীন্দ্রনাথ তার ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি লিখেছিলেন ১৮৯৫ সনে। তার প্রায় ৬০ বছর পর নন্দিত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক বিমল রায় এই ৭২ লাইনের কবিতার নির্যাস নিয়ে ১৯৫৩ সালে তৈরি করলেন ‘দো বিঘা জমিন’। কবিতা তো কবিতাই—গল্প নয়। কিন্তু কবিগুরু শব্দ ও ছন্দের মাধ্যমে এই কবিতায় যে মনোরম দৃশ্যাবলি সৃষ্টি করেছেন তার তুলনা হয় না। কবিতাটি পড়তে পড়তে মনে হবে হাঁটতে হাঁটতে কোনো এক জগতে চলে গেছি। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ‘অবারিত মাঠ’, ‘ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি’, ‘পল্লবঘন আম্রকানন’, ‘স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল’—আরো কতোকি! কবিতা নয় যেন দৃশ্যশিল্প ।
কবিতায় দেখি, উপেন নামে এক গৃহস্থের শেষ সম্বল দুই বিঘার জমির ওপর নজর পড়ে এক ভূস্বামীর। সে বাগান করবে বলে জমিটি কিনে নিতে চায়। উপেন বিক্রি করবে না। বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় মিথ্যা দেনার নামে জমি হাতিয়ে নেয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। ভিটেমাটি ছেড়ে সর্বস্বান্ত উপেনকে পথে নামতে হয়। সেদিন তার উপলব্ধি হয়, ‘এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি—রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ পরে সন্ন্যাসী হয়ে উপেন নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায় । কিন্তু তার মন পড়ে থাকে জননী বঙ্গভূমিতেই।
অনেকদিন পর সে ফিরে আসে নিজগ্রামে। কিন্তু এসে দেখে ভিটেমাটি চেনার উপায় নেই। কবির ভাষায় ‘কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন!’ তবে প্রাচীরের কাছে আজো আছে তার আমগাছটি। গাছটির নিচে উপেন একটু বসে। তখন বাতাসের ঝাপটায় দুটি পাকা আম তার কোলে এসে পড়ে। তখনই ভূস্বামীর মালী ছুটে এসে উপেনকে গালাগাল শুরু করে। ভূস্বামী ঘটনাস্থলে এলে উপেন বলে, ‘শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়’। কিন্তু ভূস্বামীর মন তো গলেই না বরং সে উপেনকে চোর সাব্যস্ত করে। চোরের অপবাদ পেয়ে উপেনের কান্নাও পায়, হাসিও পায়। মনে মনে ভাবে, ‘এই ছিল মোর ঘটে—তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!’
এই কবিতা ভিত্তি করেই বিমল রায় ‘দো বিঘা জমিন’ শিরোনামের একটি সফল হিন্দি সিনেমা নির্মাণ করলেন। সিনেমার একাংশ সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরীর ‘রিকশাওয়ালা’ নামের একটি গল্প অবলম্বনে তৈরি। সলিল চৌধুরী এই সিনেমার সংগীত পরিচালকও। সিনেমায় উপেনের বদলে দেখি কৃষক শম্ভুকে। অসুস্থ বাবা, স্ত্রী পার্বতী এবং একমাত্র সন্তান কানাইয়াকে নিয়ে তার পরিবার। কারখানা তৈরি করতে জমি খুঁজছে একটি কোম্পানি। জমি খুঁজে দেয়ার দায়িত্ব নেয় স্থানীয় এক প্রভাশালী ব্যক্তি—যাকে সবাই ‘ঠাকুর’ বলে সম্বোধন করে। ঠাকুর কারখানার জন্য শম্ভুর মালিকানাধীন দুই বিঘা জমিই নির্বাচন করে। কিনতে চায় কিন্তু শম্ভু বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানায়। চটে যায় ঠাকুর। শম্ভুর কাছে সব মিলিয়ে তার পাওনা ছিল ৬৫ রুপি। জালিয়াতি করে পাওনা—৩৩৫ রুপি দাবি করা হয়। এই টাকা শোধ করা শম্ভুর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। বিষয়টি আদালতে পর্যন্ত গড়ায়। আদালতে শম্ভু প্রমাণ করতে পারে না—তার আসল দেনা যে মাত্র ৬৫ রুপি। আদালত টাকা পরিশোধ করতে তাকে তিন মাসের সময় বেঁধে দেয়। এরমধ্যে টাকা পরিশোধ করতে না পারলে তাদের সকল জমি নিলামে তোলা হবে।
টাকা রোজগারের আশায় শম্ভু ছেলে কানাইয়াকে নিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমায়। শুরু হয় তার কঠিন জীবন সংগ্রাম। স্থানীয়দের সহযোগিতায় শম্ভু হাতে টানা রিকশা চালাতে শুরু করে। অন্যদিক কানাইয়া বুট পলিশের কাজে লেগে যায়। দুজনে মিলে দেনার টাকা জমাতে থাকে। শম্ভু সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হলে রিকশা চালানো বন্ধ হয়ে যায়। উপায় না দেখে কানাইয়া চুরি করে টাকা কামানোর চেষ্টা করে। চুরির টাকা এবং সেই টাকায় কেনা ওষুধ ও ফল ফেলে দেয় আত্মমর্যাদা সম্পন্ন শম্ভু। ছেলেকে এজন্য কঠিন শাস্তিও দেয় সে। ওদিকে স্বামী ও সন্তানকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে কলকাতায় এসে এক লম্পটের পাল্লায় পড়ে পার্বতী। তার কাছ থেকে বাঁচতে পালাতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কায় আহত হয় সে। রাস্তায় পড়ে থাকা পার্বতীকে হাসপাতালে নিতে কাকতালীয়ভাবে শম্ভুই সেখানে হাজির হয়। পার্বতীকে হাসপাতালে নেয়ার পর সেখানে পৌঁছায় কানাইয়া। সে ভাবে, তার চুরির পাপে তার মা শাস্তি পেয়েছ। সে চুরির টাকা ছিঁড়ে ফেলে। পার্বতীর চিকিৎসায় জমানো সব টাকা ফুরিয়ে যায়। ফলে ঠাকুরের ঋণ আর পরিশোধ করা যায় না। শম্ভুর বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে তাদের সব জমিজমা কেড়ে নেয়া হয়। শম্ভুর বাবা পাগল হয়ে নিরুদ্দেশ্যে হয়ে যায়। সিনেমারা শেষে আমরা দেখি শম্ভু তার স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে একটি কাঁটাতারের বেড়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারা দেখে—তাদের জমিতে গড়ে উঠেছে কারখানা। তারা অনিশ্চিত জীবনের দিকে পা বাড়ায়।
বিমল রায় শম্ভুদের এই কলকাতার জীবনটা সাজিয়েছেন সলিলের গল্প অবলম্বনে। শুরু, শেষ এবং মূল ভাবনাটা রবীন্দ্রনাথেরই। রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক ভাবনাকে বিশদ পরিসরে নিয়ে গেছেন বিমল। কবিতার রোমান্টিসিজম এড়িয়ে তিনি কঠিন রিয়ালিজমকে প্রকোট করে তুলেছেন। পরিচালক দেশভাগ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আর্থসামাজিক অবস্থায় (মন্বতর) শম্ভুকে স্থাপন করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নিও–রিয়ালিস্টিক বা নব্য–বাস্তববাদী একটি সিনেমা তখন সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল—ইতালির ‘বাইসাইকেল থিভ্স’। ভিত্তোরিও দে সিকা পরিচালিত সিনেমাটি ১৯৪৮ সালে মুক্তি পাওয়ার পর বিমল রায় এমন একটি হিন্দি সিনেমা করার কথা ভাবেন। তাই ‘দো বিঘা জমিন’–এর ক্যামেরার কাজ, অভিনয় এবং পোস্ট–প্রেসেসিংয়ে ‘বাইসাইকেল থিভ্স’–এর প্রভাব আঁচ করা যায়।
শম্ভুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন শক্তিমান অভিনেতা বলরাজ সাহনী, পার্বতী চরিত্রে নিরুপা রায়, ঠাকুরের চরিত্রে মুরাদ এবং কানাইয়ের চরিত্রে রতন কুমার। ‘ট্রান্সফরমার্স’ সিনেমা সিরিজের যুগে বসে ‘দো বিঘা জমিন’কে ম্যালোড্রামা মনে হতে পারে। তখন এখানকার অভিনয় মঞ্চ থেকে পুরোপুরি বের হয়নি। যাহোক, সেসময়ের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে বলা যায়, সবার অভিনয়ই মনে রাখার মতো। তবে যার সবচেয়ে বেশি অবদান রাখার কথা—সেই বলরাজ তার পুরোটা দিয়েছেন। তিনি পুরোপুরি শম্ভু বা উপেন হতে পেরেছিলেন। সিনেমাটোগ্রাফি মনমুগ্ধকর। সাদাকালো ল্যান্ডস্কেপ দৃশ্যগুলো চোখে লেগে থাকে। ট্র্যাকশট ও প্যানিং নিখুঁত। একটি দৃশ্য তো অনবদ্য; সড়কের একদিকে ঘোড়া গাড়ি টানছে, অন্যদিকে মানুষ (শম্ভু) টানছে গাড়ি। অদ্ভুত পরস্পর–বিরোধী ও প্রতীকী দৃশ্য।
এই সিনেমার অন্যতম শক্তির জায়গা সংলাপ। ‘পেট ছাড়া গরীরের আর কিছুই নেই’, ‘হায়রে শহর দেবে না তো কিছুই সবই নিয়ে গেলো’—এমন অনেক সংলাপ মনে গেঁথে যায়। শম্ভু ঠাকুরকে বলে, মাটি তো মা তাকে কিভাবে বেচি, ঠাকুর বলে—কারখানা হলে মা বাপ হয়ে যাবে। শম্ভুকে ঠাকুরের উকিল জিজ্ঞাসা করে, সে যে টাকা পরিশোধ করেছে তার কোনো সাক্ষী আছে কিনা। শম্ভু বলে, সাক্ষী তো ভগবান। উকিল বলে, তাহলে তাকেই বলো এসে সাক্ষী দিতে। সিনেমার প্রতিটি সংলাপ খুবই যত্নে গঠিত।
রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু বিমল রায় এই বিষয়টি ছাড়াও শহর বনাম গ্রাম, সুবিধাভোগী বনাম বঞ্চিতের লড়াইটাকেও যোগ করেছেন সিনেমায়। আরো দেখিয়েছেন, এই লড়াইয়ে জয় হয় সবলেরই। রবীন্দ্রনাথও উপেনকে বিজয়ী করেননি। এটাই বাস্তবতা। তবে দুর্বলের আত্মসম্মানকে মহিমান্বিত করা হয়েছে, ‘জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’। কানাই যখন চুরির টাকা নিয়ে বাবার কাছে ফেরে তখন শম্ভু রাগে ক্ষোভে বলে, ‘তুই কৃষকের ছেলে হয়ে চুরি করেছিস!’ সংলাপটা অদ্ভুত! এখন আমাদের শুনতে হয় চাষারাই নাকি অসভ্য!
আগেই বলেছি সিনেমার শেষদিকটাও বিশ্বকবির ‘দুই বিঘা জমি’র অনুপ্রেরণায় করা। বাস্তুচ্যুত হয়ে নিরুদ্দেশ্যে পাড়ি জমানোর সময় শম্ভু ভিটার একমুঠো মাটি তুলে নেয়। প্রহরী এসে বলে, কি চুরি করেছো দেখাও। শম্ভু বলে, আমি চুরি করিনি। মুঠি খুলে দেখাতে বলে প্রহরী। মুঠি খুলতেই মাটিগুলো নিচে পড়ে যায়। নিজের ভিটার একমুঠো মাটির ওপরও শম্ভুদের আর কোনো অধিকার থাকে না। উল্টো চুরির অপবাদ পেতে হয়। রবি ঠাকুরের কবিতায় একমুঠো মাটির বদলে ছিল দুটি পাকা আম। সিনেমায় দুটি আমের কি সৃজনশীল অনুবাদ!
রবীন্দ্রনাথ সমাজতান্ত্রিক ছিলেন না। সলিল চৌধুরী স্বঘোষিত মার্কসবাদী। তবে ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় মানুষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে—তা অতুলনীয়। এই দুজনের সৃজনশীল কর্মকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বিমল রায়। ১৯৫৪ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে চলচ্চিত্রটি গ্র্যান্ড প্রাইজের (সেরা ছবি) জন্য মনোনয়ন পায়। তবে অর্জিত হয় ‘প্রিক্স ইন্টারন্যাশনাল’ পুরস্কার। ১৯৫৪ সালে ফিল্মফেয়ার এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের যাত্রা শুরু। সে বছরই সেরা সিনেমা এবং সেরা চলচ্চিকার বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পায় ‘দো বিঘা জমিন’। সেরা সিনেমা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘অল ইন্ডিয়া সার্টিফিকেট অব মেরিট’ অর্জন করে সিনেমাটি। কারলোভি ভারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও এই সিনেমা পুরস্কৃত হয়।