বাংলাদেশ ও ভারত—উভয় দেশে এক এক করে সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নব্বইয়ের দশকেও বাংলাদেশে প্রায় দেড় হাজার সিনেমা হল ছিল। ২০১৯ সালে সে সংখ্যা ১৭৪-এ নেমেছে। গবেষাণা প্রতিষ্ঠান ‘আর্নস্ট এন্ড ইয়ং’-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে কিছুদিন আগেও প্রায় সাড়ে ৯ হাজার সিনেমা হল ছিল। ২০২০ সালে সেখানে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ১ হাজার হল। বন্ধ হওয়ার এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে করোনাকাল। দুই দেশেই শত শত সিনেমার কাজ স্থগিত মহামারির কারণে। আর অগণিত সিনেমার কাজ বাতিল হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অসংখ্য মানুষ। শত শত কোটি টাকার লোকসানের ভার বহন করে ধুকে ধুকে চলছে এই শিল্প। শুধু ভারতেই বক্স অফিস থেকে বছরে আয় হতো প্রায় ৪০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেখানে এখন থমথমে অবস্থা।
টেলিভিশনে নতুন সিনেমা মুক্তি দিয়ে লোকসান পোষানো যায় না। এমন এক পরিস্থিতিতে ভিডিও স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম বা ওটিটি প্লাটফর্ম আশার আলো দেখাচ্ছে। ছোট থেকে শুরু করে বড়—সবাই এখন ওটিটিমুখী। সেদিকে না গিয়ে উপায়ও যে নেই। এখন প্রযোজকেরা ওটিটিতেই তাদের নতুন সিনেমা মুক্তি দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তারা নিজেরাও ওটিটি প্লাটফর্মের ব্যবসা খুলছেন। বাংলাদেশের ভিডিও স্ট্রিমিং বাজার কত টাকার তা এখনো জানা যায়নি, তবে ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন বলছে, ভারতে ২০২৪ সাল নাগাদ ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার তৈরি হবে। ‘আরবিএসএ অ্যাডভাইজার্স’ নামের একটি ভারতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ২০৩০ সালে তা ১৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে। সুতরাং এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ না করা ব্যবসায়ীদের জন্য বোকামি। বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের বাজার স্বাভাবিকভাবেই বড়, সেখানকার বিনিয়োগও বড়, তাদের কন্টেন্টও প্রচুর, তাই সেখানকার স্থানীয় ওটিটিগুলো ভালোই করবে। বাংলাদেশের বাজারটা যেন আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। অন্যদিকে কন্টেন্ট সংকটের আশঙ্কাও সম্ভবত আমাদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
এই সম্ভাবনাময় বাজারের হাতছানি পশ্চিমারা আগেই দেখতে পেয়েছিল। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ফরচুন বিজনেস ইনসাইট’ বলছে, ২০১৮ সালে সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বাজারের আকার ছিল ৩০ দশমিক ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের, যা ২০২৬ সালে ৮৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। আর এই ২০২২ সালের মধ্যেই ওটিটির গ্রাহক সংখ্যা ৫০ মিলিয়নের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। এই বিশাল বাজার ধরতে মার্কিন ওটিটি প্লাটফর্মগুলো প্রতিনিয়ত কাজ করছে। তারা শুধু এখন আমেরিকার বাজার নিয়ে ভাবছে না—তার বাইরে, যেমন—ভারতবর্ষের বাজার দখলেও উঠেপড়ে লেগেছে। ‘নেটফ্লিক্স’, ‘অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও’, ‘ডিজনি প্লাস’, ‘এইচবিও ম্যাক্স’সহ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এক মহা ও অভূতপূর্ব প্রতিযোগিতায় নেমে গেছে। তার তুলনায় এ অঞ্চলের উদ্যোগ নগণ্য।
‘জিএসএম অ্যাসোসিয়েশন’-এর ‘মোবাইল ইকোনমি প্রতিবেদন ২০১৮’ অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে মোবাইলফোন হবে প্রধান ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০২৫ নাগাদ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬১ শতাংশের হাতে মোবাইল ইন্টারনেট পৌঁছে যাবে। এই পরিসংখ্যান থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, ওটিটি প্লাটফর্মের কদর আগামীতে আরো বাড়বে। ওটিটির সুবাদে একাধিক সিনেমা হল চলে এসেছে হাতের মুঠোয়—একেকটি সিনেমা হলে শত শত সিনেমা, ওয়েব সিরিজ, ডকুমেন্টারি, রিয়ালিটি শো আরো কতকি!
বাংলাদেশেও এই বাস্তবতার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন’ (বিটিআরসি)-এর তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জুন নাগাদ বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২০ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন। এরমধ্যে মোবাইলফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১১০ দশমিক ৯০ মিলিয়ন। বুঝাই যাচ্ছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে ওটিটির সম্ভাবনাও বাড়ছে, আরো বাড়বে। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে, দেশে ওটিটির ৮০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষের বাজার রয়েছে। সাবস্ক্রিপশন চার্জ যদি ১০০ টাকাও ধরা হয় তাহলেও মাসে ১০০ কোটি টাকার বাজার।
২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নেটফ্লিক্স-এর কমপক্ষে দুই লাখ গ্রাহক আর হইচই-এর ২২ হাজার গ্রাহক রয়েছে (২০১৯)। এক এক করে দেশের অভ্যন্তরেও ওটিটি প্লাটফর্ম বাড়ছে, বঙ্গ, বিঞ্জ, বায়োস্কোপ, সিনেমেটিক, বাংলাফ্লিক্স, আড্ডাটাইমস, সিনেস্পট, চরকি, সিনেবাজ ইত্যাদি। যদিও ব্যবসা করতে না পেরে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে আইফ্লিক্স বন্ধ হয়ে গেছে। তবে সেই সময় আর এই সময় এক নয়। মহামারির পর এই খাতের সম্ভাবনা হুট করেই বেড়ে গেছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনই আটঘাট বেঁধে ময়দানে নেমে পড়তে হবে। বাজার ধরার এখনই সময়।