জাগছে কাশ্মীরি সঙ্গীত

কাশ্মীরের সন্তুর

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত-পাকিস্তানের বিবাদে পড়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে কাশ্মীর। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনত্বে এখানে সেনাবাহিনী নিয়োজিত আছে, প্রতিনিয়ত নজরদারি আর মৃত্যুভয়ে মানুষের জীবনযাত্রা হুমকির মুখে। আর এখানকার অত্যাচারিত মানুষের পরিচয় ও প্রতিবাদের ভাষা ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বের অগোচরে চলে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা ভাবতে শুরু করে, ইংরেজি শিখলেই শুধু তাদের সন্তানেরা পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে। ফলে কাশ্মীরের ভাষা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে; তার জায়গা নিতে শুরু করে উর্দু আর ইংরেজি। বছরের পর বছর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষ্পেষণ ছাড়াও সাম্প্রতিক অতিমারির ধাক্কায় স্থানীয় লোকসংস্কৃতির চর্চা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তবে সঙ্গীতের হাত ধরে বদলের হাওয়া লেগেছে এখানে। তিন দশকের অত্যাচারের পরও নতুন করে জেগে উঠছে কাশ্মীরের সঙ্গীতাঙ্গন, যার হাল ধরেছেন সাফুদ্দিন, আলিফ ও রামুজের মতো তরুণ শিল্পীরা। হিপ-হপ ঘরানার গানে কণ্ঠে প্রতিবাদী সুর তুলেছেন কাফিলাহ, আহমার, এসএক্সআর, স্ট্রেইট আউটা শ্রীনগরের মতো র‍্যাপাররা।

হারিয়ে যেতে বসেছে কাশ্মীরের সুফি সঙ্গীত

কাশ্মীরি সঙ্গীতে এই রেনেসাঁ যার হাত ধরে আসে, তিনি হলেন রৌশান ইলাহি ওরফে এমসি ক্যাশ। কাশ্মীরের ভেতরকার অজানা বাস্তবতা আর সেখানকার মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি গেয়েছিলেন ‘আই প্রটেস্ট’। ২০১০ সালে প্রকাশিত এই গানটি ইউটিউবে রাতারাতি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। এরপরই যে স্টুডিওতে এই গানটি রেকর্ড হয়েছিল, সেখানে নিরাপত্তা রক্ষীরা তল্লাশি চালায়, গানটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।

সঙ্গত কারণেই এই ঘটনার পর স্থানীয় অন্যান্য শিল্পীরা রৌশানের সঙ্গে কাজ করতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। এই শিল্পীকে নিয়েই স্থানীয় র‍্যাপার আহমারের ‘ইনকালাব’ অ্যালবামে আছে একটি রেকর্ডিং, নাম ‘রৌশান’। এতে এমসি ক্যাশ সহ অন্যান্য শিল্পীদের মুখে জানা যায়, কেমন ভয়াবহ নির্যাতন করে তার মুখ বন্ধ করা হয়।

আলিফ

গোটা অ্যালবাম জুড়ে কাশ্মীরে খুন-রাহাজানি-অপহরণ সহ মানবতার চরম অবক্ষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। আহমার বলেন, “এখানে সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের সুযোগ নেই, তাই আমরাই তাদের কণ্ঠ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।”

উর্দু ও কাশ্মিরী ভাষার শিল্পী আলী সাফুদ্দিন কিশোর বয়সে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন। এরপর এই শিল্পী কাশ্মিরী লোকসঙ্গীতের সঙ্গে পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে রক মিউজিকের ভাষায় শুরু করেন প্রতিবাদের গান।

এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ২৯ বছর বয়সী সাফুদ্দিনের ‘রেহাম কারাইন’ গানটি মুক্তি পেয়েছে। উর্দু ভাষার এই শিরোনামের অর্থ ‘দয়া করুন’। কবি জিসান জয়পুরির লেখা এই গানে কাশ্মীরের ভেতরকার সাধারণ মানুষের জীবনের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে। ২০১৬ সালে কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর হাতে অন্তত ১২০ নাগরিক হত্যার প্রতিবাদে সাফুদ্দিন গেয়েছেন ‘তুম কিতনে জাওয়ান মারোগে’।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেন্ডেন্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাফুদ্দিন বলেন, “বিশ্বায়নের কারণে আমাদের নিজেদের সংস্কৃতি হুমকিতে পড়েছে। পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া সবকিছু প্রতিনিয়ত নতুন সব তথ্যের বিস্ফোরণে হারিয়ে যাচ্ছে। আর ভারত কাশ্মীরকে রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় রাজনৈতিক সংঘাত তো আছেই।’’

কাশ্মীরে ঔপনিবেশকতার প্রভাব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, “তরুণদের কাছে নিজের ভাষা নিয়ে গর্বের অনুভূতি পৌঁছে দিতে সমসাময়িক কেউ ভূমিকা রাখতে পারে, যে তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। আমি বিশ্বাস করি, নিজেকে কাশ্মীরি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়ায় যে গর্ব, আমার সঙ্গীতে তার ছাপ আছে।”

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কাশ্মীরের রক্ষাকবচ আর্টিকেল ৩৭০ প্রত্যাহার করে নেয় ভারত সরকার। হাজার হাজার নতুন সৈন্য এসে এখানে ঘাঁটি গাড়ে, রাজনৈতিক নেতাদের গৃহবন্দি করে, কার্ফিউ জারি ও যোগাযোগ নিষিদ্ধ করে গোটা উপত্যকা অচল করে ফেলা হয়। এরপর কাশ্মীরের মানুষের উন্নয়নের অজুহাতে বাইরের মানুষের কাছে জমি বিক্রি শুরু হয়, হু হু করে পর্যটক আসতে শুরু করে। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত কাশ্মীরের অর্থনীতি তাতে বরং ভেঙে পড়ে।

২৬ বছর বয়সী র‍্যাপার কাফিলাহর গান মাত্র তিনটি, কিন্তু কণ্ঠে প্রতিবাদী সুর তুলতে তার দ্বিধা নেই। তার ‘ফারার’ গানে অত্যাচারী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সরাসরি বার্তা দিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, প্রতিনিয়ত এই মানবতার বিপর্যয় এখানকার শিল্পীদের মাথা তুলে দাঁড়াতে বাধা দিচ্ছে। বলেন, “এখানকার মানুষ নিজেরাই নিজেদের দেখাশোনা করতে বাধ্য হয়। এখানে একদিন বাঁচলেই সে বিশাল ব্যাপার। আর্টের জন্য কারোর সময় নেই।’’ তিনি আরো জানান, সঙ্গীতায়োজনে উপযোগী বেশিরভাগ স্থানই সরকারি মালিকানায় থাকাটা সমস্যার।

সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে কাশ্মীরের প্রতিবাদী কবিদের উপর পুলিশের নির্যাতনের চিত্র উঠে আসে। কাশ্মিরি সঙ্গীতের বিস্তারে বাধা দিতে গোপনে তাদের গান ব্লক করা হয় বলেও জানিয়েছেন অনেক শিল্পী। এর কারণ হিসেবে রক ব্যান্ড রামুজের জিসান নবী বলেন, “কাশ্মীরি হওয়ার আর বেঁচে থাকা – দুটোই নিষ্পেষণের বিরোধী। তাই এসব তাদের জন্য ভয়ের।” ব্যান্ডটির প্রথম অ্যালবাম ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে এখনো আটকে আছে।

নিজের গান নিয়ে গোটা বিশ্বকে জানান দিতে সম্প্রতি আহমারের ‘আজাদী’ রেকর্ডসের সঙ্গে চুক্তির দিকে এগিয়েছেন সাফুদ্দিন। তিনি বলেন, “এখানে যেকোনো সময় যেকোনো কিছুই বন্ধ হয়ে যেতে পারে, গোটা বিশ্ব থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারি। তাই শ্রোতার সংখ্যা বাড়াতে হলে বাইরের সহায়তা দরকার হবেই।”

এছাড়াও বেঙ্গালুরু ভিত্তিক জনপ্রিয় ব্যান্ড পারভাজ ও পুনের আলিফ কাশ্মীরি ভাষার সঙ্গীতের বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিকূলতার মধ্যেও নারীর টিকে থাকার শক্তি নিয়ে আলিফের গান ‘ঝেলুমুস’, আর মানুষের জীবন ও স্বপ্নের প্রতি অবহেলা নিয়ে ‘ইকেবানা’ গান দুটি কাশ্মিরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আর তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘মালাল ক্যায়া হুয়া’র বিষয়বস্তু হল মানসিক স্বাস্থ্য।

রামুজের নবী বলছেন, জীবনের মানে খুঁজে বের করতে তাদের সাহায্য করে সঙ্গীত, আর কারো কারো জন্য তা টিকে থাকার আশ্রয়ও। তাই সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেও গত পাঁচ বছর ধরে, কাশ্মীরে ছোট্ট কিন্তু স্বাধীন একটি সঙ্গীত অঙ্গন গড়ে উঠছে। ভবিষ্যতে ডালপালা ছড়িয়ে তা এক মহীরুহে বেড়ে উঠবে, এমন আশায় বুক বাঁধছেন তিনি।

এমন আরো সংবাদ

সর্বশেষ বিনোদন