হলিউডে প্রাধান্য পাচ্ছে আদিবাসী সংস্কৃতি

অন্তত ১৫,০০০ বছর আগে থেকে বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার আশপাশের অঞ্চলে বসবাস করে আসছে নেটিভ আমেরিকান জনগোষ্ঠী। ১৪৯২ সালে এই অঞ্চলে ইউরোপীয়রা বসতি স্থাপন শুরু করলে এই জনগোষ্ঠীর ওপর চরম নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে। উৎখাত করে, হত্যা করে তাদের বসতি ছিনিয়ে নেয়া হয়। এমনকি বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে।

ষাটের দশকে এসে আমেরিকান আদিবাসী সোচ্চার হয়, তারা আন্দোলনে নামে, আর তাতে ধীরে ধীরে তাদের অবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন হতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশটিতে ৫৭৪টি নেটিভ অ্যামেরিকান গোষ্ঠীর ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করে। এর ৭৮ শতাংশই আমেরিকান রিজার্ভেশনের বাইরে, ধীরে ধীরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে তারা।

এই নেটিভ আমেরিকানদের হলিউড সবসময় হিংস্র যোদ্ধা, কিংবা সাদা চামড়ার মানুষের বিরুদ্ধাচরণকারী হিসেবে দেখিয়ে এসেছে। অথবা এমন এক চরিত্র হিসেবে, যার রহস্যময় উপদেশ উপযুক্ত সময়ে কেন্দ্রীয় চরিত্রের কাজে আসে। এমনকি এসব চরিত্রের জন্য বেশিরভাগ সময় শ্বেতাঙ্গ অভিনেতাদের বেছে নেয়া হতো। বারবার এই ধরনের উপস্থাপনের কারণে ন্যাটিভ আমেরিকানরা পর্দায় তাদের স্বাভাবিক জাতিসত্ত্বার চিহ্নগুলো হারিয়েছে। দর্শকের কাছে পশুর চামড়ায় তৈরি পরিচ্ছদ আর মাথায় পালক পরা এসব চরিত্রই সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৯ আগস্ট ভিডিও স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম হুলুতে মুক্তি পায় কমেডি সিরিজ ‘রিজারভেশন ডগস’। এর আগে ২২ এপ্রিল পিকক-এ মুক্তি পায় ‘রাদারফোর্ড ফলস’। চলমান এই দুটি সিরিজের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হলো, দুটোই ন্যাটিভ আমেরিকানদের গল্প নিয়ে নির্মিত, আর বানিয়েছেন নেটিভ আমেরিকান নির্মাতারাই।

‘রিজারভেশন ডগস’-এর দুই নির্মাতা তাইকা ওয়াতিতি ও স্টারলিন হারজো দুজনেই মাওরি বংশোদ্ভূত। ‘রাদারফোর্ড ফলস’ সিরিজের অন্যতম নির্মাতা সিয়েরা টেলার অরনেলাস জাতিতে নাভাজো। তাদের হাত ধরে হলিউড অঙ্গনে নিজেদের কণ্ঠ খুঁজে পেয়েছে নেটিভ আমেরিকানরা।

‘রিজারভেশন ডগস’-এর প্রথম পর্বে দেখা যায়, সিরিজের নেটিভ আমেরিকান ‘বেয়ার’ চরিত্রের সঙ্গে এই জনগোষ্ঠীরই এক আত্মার দেখা হয়। বেয়ার তাকে কোনো বীর যোদ্ধা বলে ভুল করলেও আসলে হলিউডের চিরাচরিত কাহিনীর তুলনায় তার মৃত্যুটা হয়েছিল ভিন্নভাবে– যুদ্ধ শুরুর আগেই তার ঘোড়া হোঁচট খায়, আর ঘোড়ার নিচে চাপা পড়ে আরোহী মারা যায়। এমন সব বিচিত্র হাস্যরসের মাধ্যমে নেটিভ আমেরিকান সংস্কৃতিতে রসবোধের ভূমিকাকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন নির্মাতারা।

‘রিজারভেশন ডগস’ আর ‘রাদারফোর্ড ফলস’–দুটি সিরিজেই নেটিভ আমেরিকানদের চরিত্রগুলোর নানা দিক আর তার গভীরতাকে ধরা হয়েছে। তাতে শুধু দু-একটি চরিত্র নয়, উঠে এসছে গোটা আদিবাসী জনগোষ্ঠীই। ‘রিজারভেশন ডগস’-এর হারজো বলেন, “হাস্যরস হলো আমাদের টিকে থাকার লড়াইয়েরই অংশ। একে কখনোই পর্দায় না দেখাটা খুবই অদ্ভুত।’’ দুটো সিরিজেই চরিত্রগুলোর স্বপ্ন আছে, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম আছে, আর তারা একে অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা করতেও দ্বিধা করে না। সংক্ষেপে, মানুষ হিসেবে তাদের আরো কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেন দর্শকেরা।

‘রিজারভেশন ডগস’-এ ওকলাহোমার বাসিন্দা চার বিদ্রোহী নেটিভ আমেরিকান কিশোর ক্যালিফোর্নিয়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করতে গিয়ে মজার সব ঘটনা ঘটায়। আর ‘রাদারফোর্ড ফলস’ সিরিজে শ্বেতাঙ্গ ন্যাথান রাদারফোর্ড ও ন্যাটিভ আমেরিকান রিগান ওয়েলসের বন্ধুত্বের পরীক্ষা হয়, যখন তাদের শহর থেকে ন্যাথানের পূর্বপুরুষের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে সেখানকার বাসিন্দারা।

‘রাদারফোর্ড ফলস’ সিরিজের নির্মাতা অরনেলাস জানান, সিরিজের কাজ শুরুর সময়ই তিনি নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যকার বৈচিত্র্যকে যত বেশি সম্ভব চরিত্রের মাধ্যমে পর্দায় ধরার কথা ভাবেন। যুক্তরাষ্ট্রের নানা প্রান্ত থেকে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী ও পরিবেশে বেড়ে ওঠা লেখকদের সিরিজটির গল্প লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়। অরনেলাস মনে করেন, তাতে সিরিজের গল্প আর হাস্যরসে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা।

নেটিভ আমেরিকান সংস্কৃতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় সিরিজের গল্পে ফুটে উঠেছে। যেমন, হলিউডের সেই পানসে আর হিংস্র ন্যাটিভ আমেরিকানরা বাস্তবে কেমন বুদ্ধিমত্তা আর রসবোধ রাখে–পর্দায় তারা সবসময়ই নিজেদেরকে যেমনটা দেখতে চেয়েছেন। আধুনিক পোশাক-পরিচ্ছদে নেটিভ আমেরিকানদের এই উপস্থাপনাকে স্বাগতই জানিয়েছেন দর্শকেরা। আর নিজ সংস্কৃতি থেকে না বেরিয়ে দর্শকদের জন্য সিরিজ দুটিকে সহজবোধ্য ও উপভোগ্য করে তুলেছেন নির্মাতারা।

নেটিভ আমেরিকানদের গল্প নিয়ে তাদেরই নির্মিত সিরিজ ও চলচ্চিত্র আসছে নেটফ্লিক্সেও। এর একটি অ্যানিমেটেড সিরিজ ‘স্পিরিট রেঞ্জার’, যেখানে তিন ভাইবোন নিজেদের ন্যাশনাল পার্ককে রক্ষা করতে বন্যপ্রাণির রূপ নিতে পারে। আর ‘রেজ বুল’ হলো নাভাজো হাই স্কুলের বাস্কেটবল দলের গল্প নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র। ‘রিজারভেশন ডগস’ ও ‘রাদারফোর্ড ফলস’-এর অনুপ্রেরণায় নেটিভ আমেরিকান সংস্কৃতির বাস্তব উপস্থাপনার এই ধারা হলিউডে টিকে থাকবে, এটাই সবার প্রত্যাশা।

 

এমন আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ বিনোদন