ফটোসাংবাদিকের কাজ কি? সত্যটাকে মানুষের সামনে নান্দনিকভাবে তুলে ধরা। সেই সত্য সমাজকে নাড়া দিতে পারে, সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এই নাড়া দেয়া বা পরিবর্তন আনা ফটোসাংবাদিকের উদ্দেশ্য হতে পারে কিনা সে বিতর্ক বেশ পুরোনো। এই বিতর্কের সুরাহা হওয়ার নয়। মার্কিন ফটোসাংবাদিক উইলিয়াম ইউজিন স্মিথ চেয়েছেন কি চাননি তা অজানা, কিন্তু তার ছবি রগরগে সত্যকে বিশ্ববাসীর সামনে যখন তুলে ধরলো তখন সমাজ ও মানসে অবিস্মরণীয় পরিবর্তন হয়েছিল। বলছি, তার মিনামাতা পর্বের ছবিগুলোর কথা। আর তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ পর্বকে কেন্দ্র করেই নির্মিত ‘মিনামাতা’ সিনেমা।
‘মিনামাতা’ জাপানের একটি শহরের নাম। এই শহরেই গড়ে ওঠে ‘চিসো করপোরেশন’-এর রাসায়নিক কারখানা। ১৯৩২ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে এই কারখানা থেকে বিপুল পরিমাণে বিষাক্ত তরল বর্জ্য নিষ্কৃত হয়। যার ফলে এই শহরের ২ হাজার ২৬৫ জন এক ধরনের স্নায়ুবিক (নিউরোলজিক্যাল) রোগে আক্রান্ত হয়। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ১ হাজার ৭৮৪ জন। এই রোগের নাম হয় ‘মিনামাতা রোগ’। ১৯৭১ সালে লাইফ ম্যাগাজিনের তখনকার তারকা ফটোসাংবাদিক ইউজিন জাপানে যান এবং সেই বিষক্রিয়ার ভয়াবহ প্রভাব ক্যামেরাবন্দি করা শুরু করেন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি মিনামাতা সিরিজের ছবিগুলো তোলেন। এসময়ই তিনি তার সবচেয়ে আলোচিত ‘তোমোকো ইউমুরা ইন হার বাথ’ শিরোনামের ছবিটির সন্ধান পান। মিনামাতা রোগে আক্রান্ত তোমোকো নামের কিশোরীকে গোসল করাচ্ছেন তার মা। এই মুহূর্তটি ইউজিন অমর করে রাখেন। ১৯৭৭ সালে তোমোকো ২১ বছর বয়সে মারা যান।
কারখানার বিরুদ্ধে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়ানোর অপরাধে কারখানার লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীরা ইউজিনকে বেদম পেটায়। ১৯৭৮ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার আগে মিনামাতা ছবিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয় লাইফ ম্যাগাজিনে। পুরো পৃথিবী ছবিগুলো দেখে হতবাক হয়ে যায়। চিসো করপোরেশনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে অপরিসীম ভূমিকা রাখে এই ছবি। সাদাকালো ছবিগুলো একই সঙ্গে শিহরিত ও মুগ্ধ করে। শিহরিত হতে হয় নগ্ন বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে আর মুগ্ধ হতে হয় ছবি তোলার রোমান্টিক স্টাইল দেখে। এই সিরিজের জন্য ইউজিন ১৯৭৪ সালে ‘রবার্ট কাপা গোল্ড মেডেল’ অর্জন করেন। পরের বছর ছবি ও কথা দিয়ে মিনামাতা নামে একটি বই বের হয়। এই বই ভিত্তি করেই ‘মিনামাতা’ সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন ডেভিড কেসলার।
এন্ড্রু লেভিটাস পরিচালিত ‘মিনামাতা’ এবছরের গোড়াতেই ‘বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’-এ মুক্তি পায়। ইউজিন স্মিথের চরিত্রে অভিনয় করেছেন হলিউড অভিনেতা জনি ডেপ। তিনি এই সিনেমার অন্যতম প্রযোজকও। অভিনয়শিল্পী ও চরিত্র কিভাবে একাকার হয়ে যেতে পারে তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত এই সিনেমা। প্রায় দুই ঘণ্টার সিনেমায় একবারও মনে হবে না—জনি ডেপ আছেন। অভিনয়ের যাদুতে জনি ডেপ হয়ে যান ইউজিন স্মিথ! আমরা জানি না ইউজিন কিভাবে কথা বলতেন, কিভাবে ছবি তুলতেন—কিভাবেইবা চিন্তা করতেন। ‘মিনামাতা’ দেখে আমরা ইউজিনকে আবিষ্কার করি। হয়তো সিনেমার ইউজিন ও বাস্তবিক ইউজিনের মধ্যে অনেক ফারাক, কিন্তু জনি ডেপ তার অসামান্য অভিনয় দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন—সিনেমার ইউজিনই প্রকৃত ইউজিন। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে, ‘ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি. রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ কল্পনাকেই সত্য করে দেখিয়েছেন জনি ডেপ।
আগেই বলেছি, ফটোসাংবাদিক ইউজিনের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবি ‘তোমোকো ইউমুরা ইন হার বাথ’। আমরা কি আর জানি কিভাবে ছবিটি তোলা হয়েছিল, সেসময় ইউজিনের মনের অবস্থাইবা কেমন ছিল। সিনেমায় সেই মুহূর্তটি পুনর্নিমাণ করা হয়েছে। আপনার চোখের পলক পড়বে না দৃশ্যটি দেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত। একটি মহাছবি সৃষ্টির মুহূর্ত কেমন হতে পারে এই মহামূল্যবান দৃশ্যের মাধ্যমে তা আমাদের দেখিয়ে দেয়া হলো। স্থিরচিত্রের শক্তিকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বয়ান করা হয়েছে এই অনবদ্য সিনেমায়।