ধীমান অভিনেতা উত্তম কুমারকে আমরা পাইনি। কিন্তু তার অভিনীত চলচ্চিত্র আমাদের বুঝতে দেয়নি—তিনি আমাদের সময়ে নেই। এটি শুধু চলচ্চিত্রের শক্তি নয়—উত্তমের তাক লাগানো ব্যক্তিত্ব ও সাবলীল অভিনয়ও কাজ করেছে। আমি তাকে পুরোপুরি পাই সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘নায়ক’ সিনেমায়। এর আগেও উত্তম অভিনীত অনেক সিনেমা দেখেছি—কিন্তু ‘নায়ক’-এ এসে আমি জ্বলজ্বলে ব্যক্তিত্ব এবং তুখোড় অভিনয়ের আস্ত উত্তম কুমারকে আবিষ্কার করি। এখনো পর্যন্ত তার সেই ‘নায়ক’ই আমার চোখে সর্বোত্তম উত্তম কুমার।
সত্যজিৎ রায়ের দুটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন ‘মহানায়ক’ উত্তম। একটি তো ‘নায়ক’ (১৯৬৬), অন্যটি ‘চিড়িয়াখানা’ (১৯৬৭)। ‘চিড়িয়াখানা’ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ-গল্প অবলম্বনে তৈরি। কিন্তু ‘নায়ক’-এর গল্প লিখেছিলেন সত্যজিৎ নিজেই। উত্তম কুমারকে ভেবেই এই সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা। তিনি মনে করতেন, উত্তম খুব তাড়াতাড়ি চরিত্রে ঢুকে যেতে পারেন। চরিত্র হয়ে উঠেন। সত্যজিৎ যখন চলচ্চিত্রের লাইনে আসেননি—উত্তম তখনই নায়ক। সত্যজিতের দেখা উত্তম কুমারের প্রথম সিনেমা ‘সাড়ে ৭৪’ (১৯৫৩)। তখনই উত্তমের ব্যক্তিত্ব ও অভিনয় সত্যজিতের মনে গেঁথে যায়। তারপর দেখে ফেললেন উত্তমের আরো কয়েকটি সিনেমা।
১৯৮০ সালের আজকের এই দিনে (২৪ জুলাই) উত্তম কুমার না ফেরার দেশে চলে গেলেন। এর পরের মাসে ‘নিউ থিয়েটার্স’ উত্তম স্মরণে স্মরণসভার আয়োজন করে। সেখানেই উত্তম কুমারকে নিয়ে এসব কথা বলেন সত্যজিৎ। প্রথম দেখাতেই উত্তমকে সত্যজিতের ভালো লেগে যায়। তার চোখে উত্তম ছিলেন ‘যথেষ্ট আকর্ষণীয়’—যার মধ্যে ছিল না মঞ্চাভিনয়ের ছাপ। সত্যজিৎ বলেছিলেন, তখনই তিনি উত্তমের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন।
সত্যজিতের ধারণা যে সঠিক ছিল তা তো পরে প্রমাণ হলোই। এরপর ‘হারানো সুর’ (১৯৫৭), ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ (১৯৫৮), ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ (১৯৬০), ‘সপ্তপদী’ (১৯৬১), ‘শেষ অংক’ (১৯৬২), ‘ভ্রান্তিবিলাস’ (১৯৬৩), ‘নায়ক’ (১৯৬৬), ‘চিড়িয়াখানা’ (১৯৬৭), ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ (৯১৬৭), ‘স্ত্রী’ (১৯৭১), ‘সন্ন্যাসী রাজা’ (১৯৭৪), ‘অমানুষ’ (১৯৭৪) সহ প্রায় ২১২টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ‘নায়ক’ ও ‘চিড়িয়াখানা’র পর ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতেও উত্তমকে সন্দীপের চরিত্র অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু খলচরিত্র হওয়ায় উত্তম কুমার প্রস্তাবটি রাখতে পারেননি। পরে এই চরিত্রে অভিনয় করলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
উত্তমের মৃত্যুতে শোকাহত সত্যজিৎ ১৯৮০ সালের ২৬ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘অস্তমিত উত্তম’ শিরোনামে একটি লেখা লিখলেন। সেখানে বললেন, ‘উত্তমকুমারের অভিনয় ও ব্যক্তিত্বে সত্যিই একটা স্বাতন্ত্র্য আছে।’ এই লেখায় কোনো রাখঢাক না রেখে সত্যজিৎ বলেছেন, উত্তমের সঙ্গে কাজ করে তিনি যে তৃপ্তি পেয়েছেন ২৫ বছরের চলচ্চিত্রযাত্রায় তেমন তৃপ্তি তিনি আর কারো সঙ্গে কাজ করে পাননি।
লেখাটির শেষদিকে সত্যজিৎ বলেছেন, উত্তমের অভিনয়ের গণ্ডি খুব বেশি বিস্তৃত ছিল না। কিন্তু সেই সীমিত পরিধিতেই আজীবন উত্তম যে নিষ্ঠা ও ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন তার তুলনা হয় না। সত্যজিৎ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তার অভাব পূরণ করার মতো অভিনেতা আজ কোথায়?’ ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমার স্রষ্টা বিশ্বাস করতেন, ‘শিল্পীর বিচার সবসময়ই হয় তার শ্রেষ্ঠ কাজের উপর।’ ইতিহাস উত্তমের শ্রেষ্ঠ কাজের মূল্যায়নে কার্পণ্য করেনি। এখনো উত্তম সেরা, উত্তম আদর্শ।
তার জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, কলকাতায়। নাম ছিল অরুণ কুমার। পরে হলেন অরূপ কুমার। ‘সহযাত্রী’ সিনেমায় কাজ করার সময় তার পরিচয় হয় প্রখ্যাত অভিনেতা পাহাড়ি সান্যালের সঙ্গে। পাহাড়ির পরামর্শেই অরূপ কুমার হয়ে যান উত্তম কুমার। তার নামের মতো তার ক্যারিয়ারও অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। ১৯৫২ সালের ‘বসু পরিবার’-এ পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। সেখান থেকেই উঠে এসেছেন সফলতার এভারেস্ট চূড়ায়। কিভাবে তা সম্ভব হলো? চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, উত্তম কুমার একটি সময়কে ধরতে পেরেছিলেন। দেশভাগের পরের সময়। অভাব যখন ঘরে ঘরে, তখন উত্তমের সিনেমা সাফল্যের গল্প বলেছে। তাকে দেখে দূরের মনে হয়নি দর্শকের। উত্তম যেন তাদেরই প্রতিনিধি, ‘পাশের বাড়ির ছেলে’।