ভালো-মন্দ মিলিয়ে ‘লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান’

সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রে একটি সংস্কৃতিবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। অপরাধী খায়রুল আলম, যিনি একজন স্বনামধন্য কবি এবং ওই কেন্দ্রের চেয়ারম্যান। আমরা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র ও কবিকে সংস্কৃতি বিকাশে কাজ করতে দেখে অভ্যস্ত। এই সিরিজ আমাদের সেই ‘মাইন্ডসেটে’ আঘাত করেছে। এই যে ‘জাক্সটাপজিশন’ বা পরস্পরবিরোধী কিন্তু সহাবস্থান—এই সিরিজের একটি বিশেষ দিক। বলছি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রথম ওয়েবসিরিজ ‘লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান’-এর কথা। আমরা অনেক সময় বলি, মৌলবাদীদের কারণে সাংস্কৃতিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। ফারুকীও তা বলছেন, পাশাপাশি জানিয়ে দিচ্ছেন, সর্ষের মধ্যেও ভূত আছে। যেমন—খায়রুল আলম, হান্নান (জয়ন্ত চ্যাটার্জী) প্রমুখ।

সাবিলা নামের একজন কর্মজীবী নারী নিজের কর্মক্ষেত্রে খায়রুল আলম নামের এক ব্যক্তির যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ওই নারী সেই নির্যাতনের বিচার চায়। সমাজ অনেকটা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বিচার হওয়ার আগেই খায়রুল আলম খুন হয়। যৌন নির্যাতনের ঘটনাকে ছাপিয়ে যায় হত্যাকাণ্ড। সিআইডি তদন্ত শুরু করে এবং সাবিলাসহ কয়েকজনকে আটক করে। তারপর অনেক চরাই-উৎরাইয়ের পর আসল খুনি ধরা পড়ে।

আট পর্বের ক্রাইম থ্রিলার হলেও এই সিরিজে অপরাধকে অপরাধ দিয়ে জাস্টিফাই করা হয়নি। খায়রুল ও খায়রুলের খুনি—দুজনেই অপরাধী। আরো দেখানো হয়েছে, অপরাধ দুধরনের হলেও অপরাধের কারণ এক, পৌরুষত্বে আঘাত।

সাবিলা চরিত্রে অভিনয় করা তাসনিয়া ফারিনের অভিনয় নতুন মনে হয়নি। মনে হয়েছে স্ক্রিনে অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশাকে দেখছি, শুনছি। মরিয়া নূরের অভিনয় (লরার ভূমিকায়) মনে রাখার মতো। নাদের চৌধুরী দারুণ ভূমিকা রেখেছেন। আফজাল হোসেনের প্রশংসা করা বাহুল্য। শুধু বলবো, তিনি খায়রুল আলম চরিত্রে পুরোপুরি ঢুকে যেতে পেরেছেন। হাসান মাসুদ যে চরিত্র ও সময় পেয়েছেন তা তিনি বড়মাপের অভিনেতার মতো কাজে লাগাতে পারেননি। তারচেয়ে কম সময় ও কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পেয়ে মামুনুর রশীদ ও সাবেরী আলম তা করে দেখিয়েছেন। শুধু বসে থাকাও যে অভিনয় তা দেখালেন এই দুই গুণীশিল্পী।

জয়ন্ত চ্যাটার্জী, ইরেশ যাকের যতটা দেয়ার, দিয়েছেন। এর বেশি দেয়ার সুযোগ তাদের হয়তো ছিল না। পার্থ বড়ুয়ার ‘অ্যাংগ্রিম্যান’ লুকটা যতটা আকর্ষণীয় অভিনয় ততটা নয়। তার অভিনয় মার খায় খারাপ টাইমিংয়ের কারণে। সাবিলার স্বামী আরিফের চরিত্রে মোস্তফা মনোয়ার প্রথম ছয় পর্বে ঠিকঠাক অভিনয় করেছেন। সপ্তম পর্বে দুর্দান্ত।

চঞ্চল চৌধুরীকে শুধু শুধু টেনে আনা হয়েছে—একটি মাত্র দৃশ্যে। তাকে রাখার জন্য রাখা। সিরিজে সে একজন আগন্তুক। খায়রুল যেদিন খুন হয় সেদিন সে খায়রুলের অফিসে এসেছিল বলে সিআইডিকে জানায় মিজু (হাসান মাসুদ)। কে এই আগন্তুক, কেন এসেছিল—এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। আশ্চর্যজনকভাবে সিআইডিও এনিয়ে কোনো তদন্ত করে না।

বেশকিছু শিশুসুলভ দৃশ্য ও সংলাপ আছে। দুটি উদাহরণ দিই। তৃতীয় পর্বে সাবিলা যৌন নির্যাতনের ঘটনার যে তদন্ত শুরু হয় তা স্থগিত করার আবেদন করে বসে। যা অবাস্তব ও হাস্যকর ঠেকেছে। শহীদ চরিত্রটি সিআইডির কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এই দৌড়াদৌড়ির মধ্যেই সিআইডির এক নারী সদস্য পরিচয় গোপন করে শহীদকে দেখা করার প্রস্তাব দেয়। শহীদ ওই পরিস্থিতিতেই সেজেগুজে ডেটিং করতে বেরিয়ে পড়ে।

ক্যামেরার কাজ ও লোকেশন ভালো লেগেছে। চিরচেনা ঢাকার দৃশ্যগুলোর সঙ্গে দর্শক সহজেই সংযুক্ত হতে পারে। কখন ক্লোজ-আপ আর কখন লঙশট নিতে হয় তা সরয়ার ফারুকী অনেকের চেয়ে ভালো জানেন। রাতের দৃশ্যগুলোও মিষ্টি।

শেষটা গোটা সিরিজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শুরু থেকে আমরা দেখছি সাবিলার ‘আব্বা’ (মামুনুর রশীদ) ডিমেনশিয়া রোগী। তার স্মৃতি লোপ পেয়েছে। শেষ পর্বে এই রোগটিকেই প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সবশেষে সাবিলা আব্বার কাছে ফিরে আসে এবং অনুধাবন করে, তার আব্বাই সুখে আছে। সমাজ এবং ব্যক্তি জীবনের জটিলতা, কলুষতা ও যন্ত্রণা ভুলে থাকা অনেক সময় আশীর্বাদের মতো। সাবিলাকে বলতে শুনি, ‘এখন এসে আমার মনে হইতাছে আব্বা, এটা প্রকৃতির একটা সমাধান। প্রকৃতি মানুষকে শান্তি দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে অসুখের ছদ্মবেশে ওষুধ পাঠায়। বেঁচে থাকার জন্য ভুলে যেতে পারার চেয়ে আর বড় কোনো ওষুধ নাই আব্বা।’ এমন মুনশিয়ানাই ফারুকীর মতো পরিচালকের কাছে দর্শক প্রত্যাশা করে।

এমন আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ বিনোদন