গত ১০ আগস্ট ছিল চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের জন্মবার্ষিকী। আর আজ ১৩ আগস্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুবার্ষিকী। তাদের প্রতি থ্রিসিক্সটি বিনোদন-এর শ্রদ্ধাঞ্জলি
পুরোনো মন্দিরে ঋষির মতো লাগে সুলতানকে। জরাজীর্ণ ভবনে যেন এক বর্ণিল প্রাণ! কি এক অদ্ভুত পরস্পরবিরোধী সহাবস্থান! বলছি তারেক মাসুদের প্রথম চলচ্চিত্রের কথা। এই সেই ‘আদম সুরত’ যার জন্য তারেক মাসুদ বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পায়ে ঠেলেছিলেন। শুধু তাই নয়—জীবনের সাতটি বছর তিনি লেগে রইলেন শুধু ‘আদম সুরত’ করবেন বলে। বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও আলাপচারিতায় তারেক বলেছেন, সুলতানকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করাটা জরুরি ছিল। ১৯৮২ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে তথ্যচিত্রটি মুক্তি পায়।
প্রায় এক ঘণ্টার এই তথ্যচিত্র দেখলে দর্শকও বুঝতে পারেন—কেন এই শক্তিমান চিত্রশিল্পীকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ জরুরি ছিল। বাংলা নাম ‘আদম সুরত’ হলেও—এর ইংরেজি নাম ‘দ্য ইনার স্ট্রেন্থ’। দেশে বহু শিল্পী তখনো ছিলেন, এখনো আছেন। কিন্তু এসএম সুলতান অনন্য। যিনি ক্যানভাসে নিজেকে খুঁজতে গিয়ে বাংলার শক্তির উৎস আবিষ্কার করেছেন। আর সেই উৎস হলো গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ—যারা দেশের প্রধান চালিকা শক্তি। এই তথ্যচিত্রে সুলতান তাই তাদের কথাই বলেছেন, তাদের জীবনের জয়গান করেছেন। মনিস রফিকের ‘আদম সুরত-এর সন্ধানে আরেক আদম সুরত’সহ একাধিক লেখা থেকে জানা যায়, সুলতান ‘আদম সুরত’ তৈরি করতে দিতে রাজি হয়েছিলেন একটি শর্তে, তিনি যেন চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র হয়ে না ওঠেন। বাংলার কৃষকেরাই যেন প্রাধান্য পায়।
‘আদম সুরত’-এ সুলতান নিজের জীবনী বিশিষ্ট করে তোলেননি। তারেক মাসুদও যে তা চাননি তা স্পষ্ট। ১৯৯২ সালে আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, সুলতানের ‘যে ভেতরের শক্তির ব্যাপারটা, এই যে বক্তব্য, এইটাই হাইলাইট করা উচিত রাদার দ্যান তার জীবনের নাটকীয়তা।’ গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য সুলতানের দরদ ছুঁয়ে যায় দর্শকদের। এই মানুষের জীবনই তার জীবন। তার কষ্ট, এই দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নের কথা মুক্তিযুদ্ধের আগেও বলতে হয়েছে—এখনো বলতে হচ্ছে। তিনি বলছেন, দরিদ্র মানুষের নামেই বিদেশি সহায়তা আসে। কিন্তু ‘বিদেশি সাহায্য গ্রাম পর্যন্ত যায় না—ওটা শহর পর্যন্ত থাকে, বিলাসী দ্রব্য ক্রয় আর সভ্য হওয়ার জন্য ওগুলো ব্যবহার হয়।’ ঋণেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি। তবে সুলতানের বিশ্বাস, বিদেশি সাহায্য বন্ধ হলে শহর মরে যাবে গ্রামের কিছু হবে না। তার মতে দেশের মানুষকে নিয়ে ‘একটা প্রহসন চলছে’।
স্বৈরাচারী এরশাদ যখন ক্ষমতায় তখন এই তথ্যচিত্র নির্মিত হচ্ছে! সেই শ্বাসরুদ্ধকর সময়ে দাঁড়িয়ে শিল্পী সুলতান এসব কথা বলছেন! আর এখন ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে যায় এমন একটি শব্দও আমরা উচ্চারণ করতে পারি না। মামলা-হামলার ভয় আমাদের ‘ইনার স্ট্রেন্থ’কে খোকলা করে দিয়েছে। আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে সুলতান ও তারেক মাসুদেরা। সুলতান শিল্পী। চিন্তা ও রং-তুলিই তার অস্ত্র। তিনি নিজের চিত্রকর্মে সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র মানুষগুলোকে মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন। তিনি বলছেন, মানুষকে নিয়ে যতই প্রহসন হয় ‘আমি ততই এদের মাসল বড় করি আর মজবুত করি—তোমরা (গ্রামের মানুষ) কিন্তু ভয় পাবা না, টিকে থাকবা।’
ল্যান্ডস্কেপ থেকে বিমূর্ত—যাত্রায় সুলতানের বিষয় গ্রাম ও গ্রামের সাধারণ মানুষ। শহরের কৃত্রিম রঙ-ঢং ও ভণ্ডামি সুলতানের অপছন্দ ছিল। তাই তিনি অনেকটা স্বেচ্ছায় নির্বাস নিয়েছিলেন। ভোগ-বিলাসকে শহরে রেখে তিনি ফিরে এলেন তার শিকড়ের কাছে—তার মানুষের কাছে। তিনি জনহীন হতে চাইলেন আসলে গণশিল্পী হয়ে উঠতে। তিনি নকল মানুষ ছাড়লেন ‘মনের মানুষ’ পেতে। শিল্পচর্চার ব্যাপারেও তার ছিল ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। ‘আদম সুরত’-এ অকপটে তিনি সে ভাবনা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘মর্ডান ট্রেন্ড যেটা বর্তমান যুগে যে চলছে এটা কিন্তু আমরা মাটি থেকে অনেক দূরে গিয়ে ভাবি, মাটির কাছাকাছি ভাবি না…জনসাধারণের দুঃখ-সুখের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নাই।’ সমাকালীন চিত্রকলার নামে যা হয় তাকে তিনি নিছক ভাব-বিলাস মনে করতেন। সাধারণ মানুষ যে ছবি দেখে বুঝে না—বরং নিজের দৈন্যতা অনুভব করে—সেসব ছবিকে প্রাধান্য দিতে নারাজ ছিলেন শিল্পের জন্য আত্মোৎসর্গকারী এই মানুষটি। তার ছবিতে যে মেটে রঙের আধিক্য—তা তিনি সচেতনভাবে করতেন। মানুষ যেন ছবিতে মাটির গন্ধ ও স্পর্শ পায়।
তারেক মাসুদ নিজের চোখ দিয়ে আমাদের কিছু দেখাননি—তিনি সুলতানের চোখ দিয়েই সুলতানের কর্ম ও দুনিয়াকে দেখিয়েছেন। নিজের লেখা ‘অন্তর্যাত্রা, বহির্যাত্রা : সিনেমা যখন সহযাত্রী’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সুলতানের চোখ দিয়ে আমি গ্রামজীবনের ঐশ্বর্য অনুভব করতে পেরেছি।’ এই চলচ্চিত্র তার কাছে ছিল একটি এক্সপেরিমেন্ট—শেখার, বুঝার ও উপলব্ধির। ‘আদম সুরত’ তারেক মাসুদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শিল্পকলা—প্রধানত চলচ্চিত্র নিয়ে তার দর্শনকে ‘আদম সুরত’ ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। সুলতানের হাত ধরেই তারেক নিজের পথটি খুঁজে পেয়েছিলেন। মনিস রফিকের লেখা থেকে আরো জানতে পারি, তারেক মাসুদ নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন, ‘শিল্পী সুলতানের সংস্পর্শে আসার ফলে আমার মধ্যে খুব দ্রুত ফিল্মমেকার হওয়া এবং নাম বা যশের পেছনে দৌড়ানোর যে মানসিকতা, সেটা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি।’ তিনি এই চলচ্চিত্রটাকে বারবার ‘বাই-প্রোডাক্ট’ বলেছেন। নিজেই লিখেছেন, ‘সুলতানের সঙ্গে গ্রামবাংলার ঐশ্বর্যের স্বাদ নেওয়ার অভিজ্ঞতা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে।…সুলতানের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে আমি একক মূলধারার জাতীয় সংস্কৃতির বদলে সংস্কৃতির শত শত ক্ষুদ্র ধারা আবিষ্কার করেছি।’ প্রথম চলচ্চিত্রের পরের সবগুলো চলচ্চিত্রে আমরা সেই ‘আবিষ্কার’-এর সুফল দেখতে পাই।
২০০৯ সালে ওবায়েদ আকাশ ও সোহেল মাজহারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তারেক বলেছেন, তার ‘সব ছবি এক অর্থে একই ছবি। সেটি হচ্ছে আত্মপরিচয় ও আত্মোপলব্ধির সংকট।’ সুলতানের সব ছবিও কি একই ছবি নয়? তিনিও তো আজীবন আদি বাংলাকে, সেই বাংলার খেটে খাওয়া মানুষকে সামনের সারিতে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। ২০০০ সালে সামীম আরার নেয়া সাক্ষাৎকারে তারেক আরো বলেছেন, ‘আরবান প্রজেক্টিভ মিডিয়ার মধ্যে থাকলে রিয়েল লাইফ, রিয়েলিটি, বাংলাদেশ যে গ্রাম কৃষিপ্রধান, এগুলো জানা যায় না।’ যেন সুলতানের ভাবনারই অনুবাদ! ‘আদম সুরত-এর সন্ধানে আরেক আদম সুরত’ লেখা থেকে জানা যায়, তারেক মাসুদ বলছেন, ‘আমার মাদ্রাসাজীবনটা নিয়ন্ত্রণ আর শৃঙ্খলার মধ্যে কাটলেও পরবর্তীতে তার রি-অ্যাকশনে কিনা জানি না, অনেকটা ওয়াইল্ড জীবনযাপন করতে শুরু করি।’ সুলতানের বোহেমিয়ান জীবনের সঙ্গে কি তারেক মাসুদ তার জীবনের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন?
সুদীপ্ত সালামদৃশ্যগল্পকার ও লেখক