করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ এপ্রিল শুক্রবার রাতে মারা গেছেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি চিত্রনায়িকা কবরী। বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। শনিবার দুপুরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে এ কিংবদন্তী চিত্রনায়িকাকে। বাংলাদেশের মাননীয় রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথকভাবে শোক প্রকাশ করেছেন চিত্রনায়িকা কবরীর মৃত্যুতে।
কবরী ১৯৫০ সালের ১৯শে জুলাই চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলাতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান বোয়ালখালী হলেও শৈশব ও কৈশোর বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরীতে। তার আসল নাম মিনা পাল। পিতা শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল এবং মা শ্রীমতি লাবণ্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে কাজ শুরু করেন। কিশোরী মিনা পাল মাত্র ১৪ বছর বয়সে নির্মাতা সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় যাত্রা শুরু করেন। তিনি জরিনা চরিত্রে অভিনয় করেন। সুরকার সত্য সাহা সুভাষ দত্তকে তার খোঁজ দেন। কবরীর ছবি দেখে দত্ত তাকে পছন্দ করেন এবং তাকে অডিশনের জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ডেকে পাঠান। কণ্ঠ ও সংলাপ পরীক্ষার পর দত্ত তাকে জরিনা চরিত্রের জন্য নির্বাচন করেন। এরপর দত্তের পরামর্শে চলচ্চিত্রটির লেখক সৈয়দ শামসুল হক তার নাম পরিবর্তন করে “কবরী” রাখেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে আসেন তাঁরা। কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন কবরী। পরে ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আগন্তুক’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘সারেং বৌ’, ‘দেবদাস’, ‘চোরাবালি’। ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বউ’ ছবিতে তাঁর অভিনয় বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কার সম্মান এনে দেয়।
কবরী প্রথমে চিত্ত চৌধুরীকে বিয়ে করেন। সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর ১৯৭৮ সালে তিনি সফিউদ্দীন সরোয়ারকে বিয়ে করেন। ২০০৮ সালে তাঁদেরও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কবরী পাঁচ সন্তানের মা ছিলেন।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। যুক্ত ছিলেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’।
কিংবদন্তি অভিনেত্রী কবরীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে চলচ্চিত্র তথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক প্রকাশ করেছেন কবরীর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও একই অঙ্গনের মানুষেরা।
শাবানা: খবরটি শোনার পরই আমি বাকরুদ্ধ। কবরী নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। একটা কথাই বলবো, কবরী একজনই হয়। আমি তার জন্য দোয়া করছি। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুক।
আলমগীর: কবরীর সঙ্গে আমার ৫০ বছরের স্মৃতি।
প্রায় ২৫টি ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছি। তার চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। কবরীর সঙ্গে কাটানো স্মৃতির কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের প্রতিদিন ঝগড়া হতো, আবার মিলেও যেতাম। এ রকম একটা বন্ধুত্ব ছিল ওনার সঙ্গে। সত্তর দশকে আমি, চিত্রগ্রাহক মাহফুজ আর কবরী এই তিনজনের একটা গ্রুপ ছিল। আমরা খুব আড্ডা মারতাম একত্রে। অনেক স্মৃতি আছে। ওনার (কবরী) বাসাতেই আড্ডা মারতাম। তারপর গাড়ি নিয়ে বের হতাম। তখন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে খাওয়াতে নিয়ে যেতো। আমাদের পয়সা ছিল না। এফোর্ট করতে পারতাম না। কবরীর তুলনা কবরী নিজেই। অভিনেত্রী কবরীকে মূল্যায়ন করার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই।
ববিতা: কানাডা থেকে রাজ্জাক ভাইয়ের ছেলের বউ জানালো এই দুঃসংবাদটা। তারপর থেকে বুক ধরফর করছে। একটা সেকেন্ডও আর ঘুম হয়নি। আমার আশা ছিল কবরী আপা ফেরত আসবেন। কারণ জুয়েল আইচ লাইফ সাপোর্ট থেকে ফেরত এসেছে। আরো অনেকে এসেছে। আমার ধারণা ছিল কবরী আপাও চলে আসবেন। কিন্তু তার আর হলো না। রাজ্জাক ভাই যেদিন মারা গেলেন সেদিন এফডিসিতে গেলাম দেখতে। ঐদিনই কবরী আপার সঙ্গে শেষ দেখা হয়। তারপর আর দেখা হলো না। খবরটি শোনার পর শরীর ও মন কিছুই ভালো লাগছে না। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুক। এই দোয়া করি।
উজ্জ্বল: এই চলে যাওয়াটা মেনে নেয়া যায় না। তবুও মেনে নিতে হয়। একদিন আগেই সে মারা গেল। এখন কবরী শুধুই স্মৃতি। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
অঞ্জনা: আরেকটি নক্ষত্রের পতন। কবরী আপা নেই, মানতে পারছি না। ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। এত বড় শোক মেনে নেয়ার মতো না। বিনম্র শ্রদ্ধা সব সময় আপনার প্রতি। বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম স্বর্ণমুকুট হয়ে থাকবেন চিরজীবন।
সুবর্ণা মুস্তাফা: কবরী ফুপুর হাসি, অভিনয়, মিষ্টিমুখ- সকল বয়সের মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। রূপালী পর্দার সেরা অভিনেত্রী। আমি কীভাবে তাকে বিদায় জানাবো! দমবন্ধ লাগছে! শান্তিতে থাকুক কবরী ফুপু।
শাকিব খান: চলচ্চিত্রের যারা পথপ্রদর্শক তারা একে একে চলে যাচ্ছেন। সেই পথে পাড়ি দিলেন আমাদের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী কবরী আপা। চলচ্চিত্রের প্রাজ্ঞজনদের একজন ছিলেন তিনি। পর্দার মিষ্টি মেয়ে হিসেবে খ্যাতি পেলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্ববান মানুষ। কিংবদন্তি এই মানুষটির সঙ্গে আমার অসংখ্য স্মৃতি। যখনই দেখা হতো স্নেহ করতেন। তার সময়কার বিভিন্ন স্মৃতি শেয়ার করতেন। কবরী আপার মৃত্যুতে একজন অভিভাবক হারানোর শোক অনুভব করছি।
জয়া আহসান: বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যে খুব প্রশস্ত একটা রাজপথে উঠে গেছে, তা নয়। তবু আমরা যারা এ পথ ধরে হাঁটছি, সেটি যাদের কষ্টে তৈরি হয়েছে কবরী তাদের একজন। কোত্থেকে এসে সারা দেশের চিত্ত জয় করেছিলেন নিমেষে। পাকিস্তান আমলের উর্দু ছবির রাজত্বে তিনি আর রাজ্জাক বাংলা ছবিকে কী জনপ্রিয়ই না করে তুলেছিলেন। তার চরিত্রের মধ্যে বাঙালি মেয়ের সজল প্রতিচ্ছবি পেয়েছিলেন দর্শকরা। তিনি আকাশে জ্বলজ্বল করবেন সব সময়।
কবরীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তরা একের পর এক স্ট্যাটাস দেন। সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক অমি রহমান পিয়াল লিখেছেন, “কবরী কি ছিলেন? এই বাংলার সুচিত্রা সেন? আভা গার্ডনার? না, কবরী ছিলেন এই বাংলার কবরী। তিনি কারো মতো নন, তিনি তার মতোন। আমাদের কবরী, সোনার বাংলার সোনার মেয়ে কবরী! তিনি আমাদের একজন নক্ষত্র ছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বিপাকে পড়া বাংলা চলচ্চিত্রকে টেনে বয়ে নিয়ে গেছেন যে কজন, তাদের শুরুর কাঁধ কবরীর। আমাদের কবরী! শান্তিতে ঘুমাও সোনার মেয়ে…”।
সাংবাদিক, গীতিকার, লেখক ইশতিয়াক আহমেদ লিখেছেন, “সাদাকালো টিভি দেখা মানুষ আমরা।শাবানা, কবরীকে দেখে বড় হয়েছি।
শাবনুর, মৌসুমীরা আসার আগে তাদেরই নায়িকা জানতাম।
সেই কবরী একদিন চলে এলেন আমাদের খুব কাছে।
আমাদের আসনে দাঁড়িয়ে গেলেন অভিনেত্রী থেকে নেত্রী হওয়ার নতুন পরিচয়ে।
তারপর বছর পাঁচেক সিনেমার কবরী, সেলুলয়েডের কবরী, গানের কবরী, নাচের কবরী, হয়ে গেলেন আমাদের নারায়ণগঞ্জের কবরী, আমাদের চাষাড়ার কবরী, আমাদের জনসভার কবরী, আমাদের শহরের আইন শৃঙ্খলা কমিটির কবরী।
ক্যামেরার সামনের মিষ্টি অভিনেত্রী, ক্যামেরার বাইরে ঝাঁঝালো নেত্রী সব মিলিয়ে কবরী আমাদের কাছের মানুষ এক।
কবরীকে মনে থাকবে অনেকদিন।
করোনাকেও…।”
এক্টিভিস্ট, লেখক মারুফ রসুল লিখেছেন, “তুমিই দামিনী; পটের ঐশ্বর্য তুমি; বাঙলার মুখ যেন জাহ্নবীর তীরে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের একেবারে শেষে আয়েষা তার অঙ্গুরীয় পরিখার জলে ফেলে দেন। তুমি তাও পারবে না; কারণ হীরের মতোন ওই হাসি ওষ্ঠে রাখাই কবরীর নিয়তি। তুমি এমনই এক নক্ষত্রবীথি, যা আমাদের দূরের সম্ভ্রম থেকে নিয়ে আসে কাছের মাধুর্যে।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে ঋত্বিক ঘটকের দেয়া দূর্গা প্রতিমার মেকাপ তো কেবলই সিনেমার সাজসজ্জা নয়— তার পুরাণপ্রতিমা আদতে দৃশ্যকল্পেরও অতীত। দূর্গার বিসর্জন আদতে বিদায় নয়, আবার ফিরে আসার অবসর মাত্র।
কবরী— বিসর্জ্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে!”
ফটোফি একাডেমী অব ফাইন আর্ট ফটোগ্রাফী’র চীফ কোর্ডিনেটর সিরাজুল লিটন লিখেছেন, “চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়।”