কি গর্ব! কি দিন! কি স্বাপ্নিক মুহূর্ত!

ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাঁধন। ছবি : রেহানা মরিয়ম নূর ফেসবুক পেজ

কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার শেষে দর্শকদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ছুঁয়ে গেছে আমাদেরকেও। আনন্দিত দর্শকদের হাততালির শব্দ পৌঁছেছে সবার কানে। এই মুখরতায় যখন সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা বাঁধন কেঁদে ফেললেন—তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি আমরাও। আহা! কি গর্ব! কি দিন! কি স্বাপ্নিক মুহূর্ত! বাংলাদেশের সিনেমা যেন এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে উড়াচ্ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা!

৭ জুলাই খবর এলো, দেশে করোনায় এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হয়েছে। মনখারাপের ঘনঘটার দিনেই এক চিলতে কিরণ হয়ে ঝরে পড়লো ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর কান জয়ের খবরটি। দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকলো।

জহির রায়হানকে তো হারালাম সত্তরের দশকের গোড়াতেই। তারেক মাসুদ এলেন এবং জয় করলেন। আমরা আবার আশায় বুক বাঁধলাম। তার অনুপ্রেরণায় আরো কয়েকজন তরুণ নির্মাতাকে পেলাম। আশার মুখে ছাই! হুট করেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন তারেক মাসুদ। পড়ে রইলো পূজার সব আয়োজন। ধুলোয় ঢাকা পড়লো সিঁদুরমাখা শঙ্খ। তারপর সেই শঙ্খটিই যেন তুলে নিলেন আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। তার পরিচালিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ আমাদের সাহস দিলো আত্মশক্তি নিয়ে বিশ্ববাসীর দিকে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ যেমন করে আমাদের উস্কে দিয়েছিল।

কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর কারিগরেরা। ছবি : রেহানা মরিয়ম নূর ফেসবুক পেজ

সিনেমা দেখা শেষে কানের চলচ্চিত্র বোদ্ধারা দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর কারিগরদের তথা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে। বাংলাদেশের মুখ কি উজ্জ্বলই না হলো! কিন্তু তা কি বাংলাদেশ সরকার বুঝলো? কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘আন সার্টেন রিগার্ড’ (আঁ সাহত রিগা) ক্যাটাগরিতে সিনেমাটি মনোনয়ন পাওয়ার পর আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখলাম না। সরকারের ভাবটা এমন—যেন এটি কোনো অর্জনই নয়—মামুলি ব্যাপার। এসব অর্জন যেন আমাদের ভুরিভুরি। আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশের গতি নিম্নগামী হওয়ার অন্যতম কারণ রাষ্ট্রের এমন উন্নাসিকতা।

তবে বিশ্বসিনেমার মহারথীরা আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মতো মুখে কুলুপ এঁটে নেই। তারা টুপিখোলা অভিনন্দন জানাচ্ছেন। তারা তো অবাক, সীমিত লোকেশন, কম বাজেট এবং বড় তারকা ছাড়া বড় একটা সিনেমা হয়ে গেলো! তারা দুহাত খুলে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর কারিগরদের মুনশিয়ানা ও সংবেদনশীলতার প্রশংসা করছেন।

সিনেমাটি দেখার সুযোগ হয়নি। শুনেছি, রেহানা মরিয়ম নূর নামে একজন সহকারী অধ্যাপকের জীবন সংগ্রামের গল্পই সিনেমায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেই প্রধান চরিত্রেই অভিনয় করেছেন আজমেরী হক বাঁধন। কি আছে এই এক ঘণ্টা ৪৭ মিনিটের সিনেমায়! যা দেখে ফরাসিরাও মাত! অপেক্ষায় আছি। আশায় আছি, দেশের মানুষকে ছবিটি দেখার সুযোগ করে দেবেন নির্মাতা-প্রযোজক। নানা দিক থেকে সিনেমাটি দেখতে চাই, কিভাবে এই সিনেমা পারলো বাঘা বাঘা নির্মাতার সিনেমাকে পেছনে ফেলে দিয়ে এত্তোদূর এগিয়ে যেতে!

আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ

যতটুকু বুঝেছি, ক্ষুধা, দারিদ্র, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি জনপ্রিয় ও বাজার চলতি বিষয়ের ভিড়ে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। কিছুদিন আগে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলে উন্নীত একটি দেশের সিনেমা নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলছে! নারীর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বলছে! মানুষের লড়াইয়ের জয় জয়কার করছে! এ যেন বিলাসিতা! কিন্তু এই ভিন্ন ভাবনাকেই সালাম জানিয়েছে কান চলচ্চিত্র উৎসব।

কানের এবারের আসরে আর কতদূর যাবে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ কে বলতে পারে! পুরস্কার জুটবে কি জুটবে না নিশ্চিত করে বলা যায় না। এই যে প্রথমবারের মতো কানের মূল বিভাগে প্রতিযোগ করা, ছবি দেখে সবার দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানানো, বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রকর্মীদের ভালোবাসা—এসবেরও তো মূল্য আছে। এই প্রাপ্তিও কম নয়। পুরস্কার পাই না পাই, ‘মাটির ময়না’ ও ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর মতো চলচ্চিত্র হোক আমাদের সিনেমাযাত্রার পাথেয়।

‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর হাত ধরে কানের লাল গালিচা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাংলাদেশের সিনেমা পাড়ি দেবে আরো অনেক পথ—সে প্রত্যাশা করাই যায়।

এমন আরো সংবাদ

সর্বশেষ বিনোদন