আমার আলোকচিত্রী বাবা

ক্যান্সারের সঙ্গে চার বছরের লড়াই শেষে গত বছরের ২৭ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধা আলী যাকের। তার মৃত্যুর পর একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর আলী যাকেরের ছেলে অভিনয়শিল্পী ইরেশ যাকের বাবাকে নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় ‘বাবা এজ এ ফটোগ্রাফার’ শিরোনামে একটি লেখা লেখেন। থ্রি সিক্সটি বিনোদনের পাঠকদের জন্য সেই লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সমীরণ চক্রবর্তী

আমার সঙ্গে বাবা ও ফটোগ্রাফির প্রথম স্পষ্ট স্মৃতি ১৯৮২ সাল থেকে। খালার বিয়েতে বাবা ছবি তুলছিল। ঐ সময়েই বাবা ৪০০ আইএসও–এর একটা ফিল্ম হাতে পায় এবং আমার মনে আছে কেউ একজন তাকে বলেছিল, “এটা অনেক হাইস্পিড ফিল্ম। ৪০০ এএসএ!”

আরেকটা স্মৃতি আছে—যখন বাবা ‘ক্যানন এফ-ওয়ান’ কিনেছিল। সে সেই ক্যামেরাটি নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত ছিল। কয়েক মাস পরে বাবা ১০৫ এমএম ম্যাক্রো লেন্স কিনল। সেটি দিয়ে আমরা নিউ বেইলি রোডে আমাদের বাগানে গোলাপের ছবি তুলেছিলাম।

বাবা ক্যামেরা কিনতে খুব পছন্দ করত। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ও প্রধানত নিকনের সঙ্গে যুক্ত ছিল, আর যে প্রফেশনাল এসএলআরই বের হতো সাথে সাথে কিনে ফেলত। আমি তাকে অতিরিক্ত লেন্স এবং বেশি বডি না কিনতে পরামর্শ দিয়েছিলাম।

ক্যামেরায় এত টাকা ঢালা এবং সেসব যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহার না করার জন্য মা খুব বকাঝকা করত। বাবা প্রতিবারই একটি ক্যামেরা কেনার পর ঘোষণা দিত, এটাই শেষ। যখন কোনো নতুন মডেল বাজারে আসবে, বাবা তাৎক্ষণিকভাবে সেটা কিনবেই। নতুন ক্যামেরা বা লেন্স কিনে মার কাছে থেকে লুকাতে একটি নাটক করা হতো—সেখানে আমি বাবার পক্ষ নিতাম।

আলোকচিত্রী হিসেবে বাবা সক্রিয় ছিল আশির দশক থেকে ২০০০–এর শুরু পর্যন্ত। ও যেখানেই যেত ক্যামেরাটি সঙ্গে রাখত—তার শেষ দিনটি পর্যন্ত। অসুস্থ ছিল তবুও তিন সপ্তাহ আগে বাবা তার নিকন ডি-৫ এবং প্রিয় ২৪-১২০ লেন্সটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি রতনপুরে গেল, আমাদের শেষ বেড়াতে যাওয়া।

একজন আলোকচিত্রী হিসাবে বাবা কৌশল নিয়ে খুব বেশি ভাবত না। সে কম্পোজিশনের নিয়ম–কানুন কিংবা ‘পোস্ট-প্রসেসিং’ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। বাবা নিজের ক্যামেরার সঙ্গে বোঝাপড়া নিয়েও চিন্তিত ছিল না। ও শুধু ছবিটা তুলতে ভালোবাসত।

আমাদের বন্ধু ও সহকর্মী নেভেল প্রায়ই আমাকে বলত, আমরা চোখ দিয়ে ছবি তুলি, আর বাবা তোলে হৃদয় দিয়ে। নেভেলের মতে, আমি ফটোগ্রাফির কারিগরি দিকটা নিয়ে বেশি ব্যস্ত। তার এই কথার গুরুত্ব আমি কিছুদিন আগ পর্যন্তও অনুধাবন করতে পারিনি। কয়েক মাস আগে, কোভিড লকডাউনের মাঝখানে, আমি আমার ফটোগ্রাফিচর্চা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। সম্প্রতি তা নিয়ে আমি ভীষণ অখুশি হই। অনেক চিন্তা–ভাবনা এবং আলোচনার পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার অতৃপ্তির আংশিক কারণ, আমি সেই ছবিই তুলছিলাম—যে ছবি তোলা উচিত বলে আমি মনে করেছি। সেই ছবি তুলছিলাম না—যার সঙ্গে আমার মনের সংযোগ রয়েছে। যা ভালোবাসো তার ছবি তোলো—এটি সাধারণ বোধের বিষয়। যাহোক, এটি বুঝতে আমার ১৩ বছর লেগেছিল, বাবা যা বুঝেছিল শুরু থেকেই।

বছরের পর বছর ধরে তোলা বাবার ছবিগুলো আমার মধ্যে আলোড়ন তৈরি করে। তার ছবিগুলিতে সব সময় তার উদ্যম, কোমলতা এবং বিষয় বস্তুর প্রতি তার ভালবাসার প্রতিফলন ঘটে—বিষয়বস্তু হোক তার পরিবারের সদস্য, দেশের মানুষ কিংবা প্রকৃতি। আপনি আক্ষরিক অর্থেই তার ছবিগুলোতে তার হৃৎস্পন্দন পাবেন।
বিশেষভাবে মনে পড়ে বাবার তোলা আমার বোনের একটি পোরট্রেটের কথা। যদিও আমরা দুজনেই ওকে ভীষণ ভালোবাসতাম। শ্রেয়াকে সবচেয়ে ভালভাবে প্রকাশ করে—এমন একটি ছবি যদি আমাকে বেছে নিতে বলা হয়, আমি বাবার তোলা ছবিটিই বেছে নেব। শ্রেয়ার চোখের মায়া, তার হাসিতে সহানুভূতি, তার লাজুকতা—ধরে পড়েছে ছবিটিতে। এটি একটি আদর্শ পোরট্রেটের কাছাকাছি একটি ছবি। চোখ দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে সৃষ্টি করা একটি ছবি।

আমি মনে করি, বাবার কাছে ফটোগ্রাফি ছিল একটি প্রকাশিতব্য বইয়ের চেয়েও বেশি কিছু—ব্যক্তিগত দিনলিপির মতো। সেই দিনলিপির প্রতি পৃষ্ঠায় তার প্রেম, মমত্ববোধ ও আবেগের বিশালত্ব প্রতিফলিত হয়েছে। বাবা নিজের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন বলেই তার ফটোগ্রাফি তাকে প্রকৃত অর্থে ফুটিয়ে তুলেছিল। যে গভীরভাবে ভালোবাসত এবং যা ভালোবাসত শুধু তাই করত।

মূল : ইরেশ যাকের, অভিনয়শিল্পী

এমন আরো সংবাদ

সর্বশেষ বিনোদন