অনন্য ভাষা ও বিষয়বস্তুর ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’

১৯৭৭ সালের আজকের দিনে (৩ অক্টোবর) মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’

‘‘বাজেট সীমিত হওয়া সত্ত্বেও নিজের দক্ষতার কারণে সত্যজিৎ রায় বহু অর্থবোধক সুবিধা পেয়েছেন। তার একটি গুণ যা অনেক হলিউড পরিচালকেরও নেই—তাহলো, ইতিহাসকে দেখার দৃষ্টি। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ কিছুটা গতানুগতিক ও ধীর, কিন্তু এটি একজন অসাধারণ চলচ্চিত্রশিল্পীর ভাবনায় সমৃদ্ধ, যিনি (সত্যজিৎ) স্পষ্টভাবে জানেন, কি কারণে এই ঐতিহাসিক কাহিনী তার দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’’ ১৯৭৮ সালে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ সম্পর্কে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এ এই মন্তব্য করেছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র-সমালোচক গ্যারি আর্নল্ড। ‘ইতিহাসকে দেখার দৃষ্টি’ সত্যজিতের তৈরি হয়েছে ইতিহাসের প্রতি গভীর আগ্রহ থেকে। তার লেখালেখিতেও ইতিহাসকে বারবার উঁকি দিতে দেখি—এমনকি ফলুদা সিরিজেও। ইতিহাসের প্রতি তার আগ্রহের কথা তিনি নিজেই বলেছেন, ‘‘আমার কাছে আরেকটি আকর্ষণীয় উপাদান হল পিরিয়ড। বিগত যুগকে পরদায় মূর্ত করার সুযোগ আমি সানন্দে গ্রহণ করেছিলাম ‘দেবী’, ‘চারুলতা’ ও ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবিতে।’’ (ছবির জন্য গল্প)।

‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র একটি দৃশ্য

‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছিল সত্যজিতের একমাত্র পূর্ণদৈর্ঘ্য হিন্দি চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে সিনেমাটি মুক্তি পায়। প্রখ্যাত হিন্দি সহিত্যিক মুন্স প্রেমচন্দের ছোটগল্প অবলম্বনে চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ নিজেই। সিনেমায় অভিনয় করেছেন, সঞ্জীব কুমার, সাঈদ জাফরি, শাবানা আজমি, রিচার্ড অ্যাটেনবোরো, আমজাদ খান প্রমুখ। সিনেমায় দেখা যায়, দুই বিত্তবান—মির্জা সাজ্জাদ আলী (সঞ্জীব) ও মীর রশন আলী (সাঈদ) সবকিছু ছেড়ে দাবায় খেলায় ব্যস্ত। সিনেমার শুরু থেকে শেষতক তারা এই দাবা খেলে যায়। দাবা-আসক্তির কারণে দুজনের সংসার ভেঙে পড়তে শুরু করে—কিন্তু সেদিকে তাদের নজর নেই। মির্জার স্ত্রী খুরশিদ (শাবানা আজমি) প্রেমহীন জীবনের গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে। আর মীরের স্ত্রী (ফরিদা জালাল) বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ায়।

১৮৫৬ সন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়। অবধের রাজা ওয়াজিদ আলীর (আমজাদ খান) সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে কোম্পানি। রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে উঠেপড়ে লাগে ইংরেজ প্রশাসন। এসব কোনো কিছুই গায়ে মাখে না মির্জা ও মীর। তারা খেলে চলেছে। দেশ ও দশ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। রাজার হাতকে মজবুত করার দায়ও তারা অনুভব করে না। যুদ্ধের ভয়ে মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে, অনেকে যোগ দিচ্ছে ওয়াজিদ আলীর সৈন্যদলে—তখন এই দুই দাবাপাগল খুঁজে বেড়াচ্ছে দাবা খেলার জন্য একটি উপযুক্ত স্থান। অবশেষে তারা এমন একটি গ্রামে গিয়ে হাজির হয় যেখানকার বাসিন্দারা ভিটে ছেড়ে পালিয়ে গেছে। মির্জা ও মীর ভাবে, এরচেয়ে নির্জন জায়গা আর কি হতে পারে! শুরু হয় খেলা। অন্যদিকে বড় খেলাও চলছে, ইংরেজ সেনাবাহিনী অবধের নিয়ন্ত্রণ নিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দাবা খেলার জায়গাটি আর শান্ত থাকে না। দাবা নিয়ে মির্জা ও মীরের মধ্যে শুরু হয় বাকবিতণ্ডা। লখনৌয়ের আদব-কায়দা জলাঞ্জলি দিয়ে তারা গালাগাল শুরু করে। এক পর্যায়ে মীর পিস্তল বের করে মির্জাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোঁড়ে। যদিও গুলি মির্জার শাল ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। একটু পর অবশ্য তাদের মধ্যে সমঝোতা হয়ে যায় এবং আবার শুরু হয় খেলা।

প্রেমচন্দের গল্পের সঙ্গে সত্যজিতের চিত্রনাট্যের পার্থক্য রয়েছে। দুটি পার্থক্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গল্পে প্রেমচন্দ বলছেন, নবাব ওয়াজিদ আলীর অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণেই পুরো লখনৌ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে। সত্যজিৎ ওয়াজিদকে শিল্পমনা ও সংস্কৃতবান রাজা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। সত্যজিতের ওয়াজিদের প্রতি দর্শক সমব্যথিত হয়। আরেকটি পার্থক্য, গল্পের শেষে মির্জা ও মীর একজন আরেকজনের তলোয়ারের আঘাতে মারা যায়। সত্যজিতের সিনেমায় এদুজন মনমালিন্য শেষে আবারো দাবায় মত্ত হয়।

সাঈদ জাফরি ও সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে সত্যজিৎ

ফেলুদার স্রষ্টা মনে করতেন, ইমেজ ও ধ্বনির ভাষা স্বতন্ত্র। ফলে চলচ্চিত্র ও অন্য শিল্প-সাহিত্যের বক্তব্য এক হলেও ভঙ্গির তফাত হতে বাধ্য। বলেছেন, ‘এ ভঙ্গি বিশেষ ভঙ্গি। তাই অন্য শিল্প-সাহিত্যের লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও চলচ্চিত্র অনন্য।’ (চলচ্চিত্র রচনা : আঙ্গিক, ভাষা ও ভঙ্গি)। ভঙ্গি বদলালেও সত্যজিৎ প্রেমচন্দের মূল বক্তব্যের প্রতি আনুগত্য অটুট রেখেছেন, ‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’। নিরুর প্রতিচ্ছবিই যেন মির্জা ও মীর। মাতৃভূমি যখন হুমকির মুখে, স্বায়ত্তশাসন হারিয়ে মানুষ যখন ইংরেজদের দাসত্বে গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে তখন এই দুই ‘খিলাড়ি’ ব্যস্ত দাবার বিনোদন নিয়ে। দেশের জন্য তারা বিদ্রোহী হয়নি—কিন্তু দাবায় হারজিৎ নিয়ে লড়াই করে। সিনেমায় দেখা যায়, ইংরেজ আগ্রাসন ঠেকাতে তারা হাতে অস্ত্র তুলে না নিলেও দাবা নিয়ে দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে তারা পিস্তল হাতে তুলে নেয়, গুলিও চলে। আর মূল গল্পে তো একজন আরেকজনকে খতমই করে দেয়। অন্তর্দ্বন্দ্ব, সুবিধাবাদ ও ভোগবাদ কিভাবে রাষ্ট্রকে অন্তঃসারশূন্য করে দেয় তাই দেখানো হয় ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’তে। সিনেমা ও গল্পে দুটি দাবা খেলা পাশাপাশি চলে। একদিকে ইংরেজদের সঙ্গে নবাব ওয়াজিদ আলীর খেলা, অন্যদিকে মির্জা ও মীরের। প্রথমটি বড়, পরেরটি ছোট। বড় খেলারই প্রতীকী সংস্করণ যেন মির্জা ও মীরের খেলা। সিনেমা ও গল্পে অবধ যেন পুরো ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করছে। শেষমেশ পুরো উপমহাদেশই তো ইংরেজ শাসনে চলে যায়। ইংরেজদের পথকে এ অঞ্চলের মানুষও—বিশেষ করে শাসকেরা সুগম করেছে বলে ইঙ্গিত আছে এই গল্পে। ইঙ্গিত আর প্রতীক এক জিনিস নয়। এই সিমেমায় অনেকে প্রতীকী উপাদান আছে বলে মনে হয়—কিন্তু সেগুলো খুঁজে বের করে অর্থ খুঁজতে যাওয়া পণ্ডশ্রম হতে পারে। কেননা পরিচালক নিজেই বলেছেন, ‘চলচ্চিত্রে প্রতীক ব্যবহারের পক্ষপাতী নই, কারণ তাতে একটা সাহিত্যের গন্ধ থেকে যায়।’ (ছবি দেখার চোখ)। তাই তো! সাহিত্যনির্ভর সিনেমা যদি সাহিত্য হয়ে যায় তাহলে চলচ্চিত্রকর্ম হবে কিভাবে?

‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’

ভারতীয় চলচ্চিত্রে নিজস্ব বিষয়বস্তু সেভাবে প্রতিফলিত হয় না বলে আক্ষেপ ছিল সত্যজিতের।  ১৯৭৪ সালে তিনি বলছেন, ‘হিন্দি তথা বাংলা ভাষায় তোলা সাম্প্রতিককালের শতকরা আশিভাগ ছবিরই কোনও প্রয়োজন ছিল না কারণ তাতে না আছে শিল্পগুণ, না আছে বিষয়বস্তুর বৈশিষ্ট্য বা বলিষ্ঠতা।’ (গরম হাওয়া)। এর দুবছর পরই শুরু হয় ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র শুটিং।  এখানে তিনি বিষয়বস্তুর বৈশিষ্ট্যতা নিপুনভাবে তুলে ধরলেন। পাশাপাশি নিজেদের এক টুকরো রাজনৈতিক ইতিহাস বয়ান করলেন। শুধু ইতিহাসের গৌরবের দিকটিই নয়—তিনি তুলে ধরলেন অস্বস্তিকর চিত্রটিও।

সংলাপ এই সিনেমার প্রাণ। প্রতিটি সংলাপ মনে দাগ কাটার মতো। একদিকে মির্জা ও মীরের কমেডি ধাঁচের সংলাপ অন্যদিকে ওয়াজিদ, ওয়াজিদের মা, প্রধানমন্ত্রী ইত্যাদি চরিত্রের ভারি ভারি সংলাপ—সিনেমাটিকে করেছে ঋদ্ধ। হয়তো এজন্যই নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ভি. এস. নাইপল ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’কে শেক্সপিয়ারীয় দৃশ্যের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

অভিনয় নির্ধারিত। সঞ্জীব কুমার ও সাঈদ জাফরিই সিনেমার প্রধান চরিত্র। তাদের পরই আমজাদ খান (ওয়াজিদ আলী ভূমিকায়)। তারপর বেশি সময় পেয়েছেন রিচার্ড অ্যাটেনবোরো। এরা তো দুর্দান্ত করেছেনই—বাকিরাও সীমিত সময় ও সংলাপেও উজ্জ্বল। শাবানা আজমি, ফরিদা জালাল, ভিক্টর ব্যানার্জি যা পেয়েছেন তার সদ্ব্যবহার করেছেন। ওয়াজিদ আলীর মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বীণা কুমারী। সবচেয়ে কম সময় পেয়েছেন তিনি। জেনারেল তার সঙ্গে দেখা করতে আসে এবং জানায় তারা তার ছেলেকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে দিতে চাইছে। তখন বীণা দৃঢ়তার সঙ্গে কিছু সংলাপ বলে যান। প্রতিটি শব্দ কানে বাজে, মনে হয় তারচেয়ে ভালো আর কেউ করতে পারতেন না।
এই সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনও আছেন—তবে নেপথ্যে। এই সিনেমার কথক তিনি। তার মোহনীয় কণ্ঠের জবাব নেই।

সত্যজিৎ মনে করতেন, ‘চলচ্চিত্রের প্রকৃত উৎকর্ষ নির্ভর করে তাঁহারই উপর যিনি এই সাহিত্য ভাষাকে চিত্রভাষায় অনূদিত করেন—অর্থাৎ চিত্রপরিচালক।’ (চিত্রনাট্য)। আর সাহিত্যকে চলচ্চিত্রে অনুবাদে সত্যজিৎ রায়ের মতো রসিক নির্মাতা বঙ্গদেশে কজন আছেন! তা সে বিভূতিভূষণের সাহিত্যই হোক কিংবা প্রেমচন্দের।

সুদীপ্ত সালাম দৃশ্যগল্পকার ও লেখক

এমন আরো সংবাদ

সর্বশেষ বিনোদন