কানাডায় সামার ক্যাম্পিং

সারাবছর মন-মনন আর মস্তিষ্ক যে ধুলো-ময়লা আর আবর্জনা জমা করে তা দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসতেই হয়। ভয়ংকর সুন্দর কটা দিন আর কতশত মধুর মূহূর্ত পাবার জন্য নগর ছেড়ে প্রতিবছর আমরা গ্রাম্য জীবনে ফিরে যাই। সামারে প্রকৃতির মাঝে কাটানো এ জীবনকে বলি আমরা সামার ক্যাম্পিং।
কানাডার কুইবেক প্রদেশের মন্ট্রিয়ল শহর থেকে ১৬২ কিলোমিটার দূরে ওয়াটারভিলেতে সামার ক্যাম্পিংয়ে যাই আমরা। যেতে বেশি সময় লাগেনি। এক ঘণ্টা ৫৫ মিনিটেই গন্তব্যে পৌঁছাই। এখানে সামার ক্যাম্পিংয়ে প্রতি রাতের জন্য খরচ করতে হয় ১৩৫ কানাডিয়ান ডলার।
ঝুলন্ত বিছানা আর তারাভরা রাত
একসময় বারান্দায় মাদুর পেতে শুয়ে শুয়ে চাঁদনী রাতে আকাশ দেখা আমার পুরোনো অভ্যাস। বোধ হয় এখনো তা আছে। আমি সুযোগ পেলেই মাদুরে গড়াই আকাশ দেখবো বলে।
সামার ক্যাম্পিং এ প্রতিবছর যাবার একটাই কারণ, আর তা হল গভীর অন্ধকারে তারাভরা আকাশ দেখার শখ। আমি এই আকাশের টান কেন যেন এড়াতে পারি না। গভীর রাতের আকাশ আমাকে ডাকে।গতবছর এই ঘরটা যখন ভাড়া নিলাম, প্রথমে ঘরটায় ঢুকে আমি চমকে উঠেছিলাম। মন বারবার বলছিল, ওমা ! এ তো আমার সেই স্বপ্নের বাড়ি ! প্রথমে ঝুলন্ত বিছনায় উঠার সাহস হচ্ছিল না। এমন ভাবে ঝুলানো ছিল বিছানাটা যে মনে হচ্ছিল তাতে উঠলেই বুঝি ছিঁড়ে পড়বে ! ভাঁজ করা মই খুলে একপ্রকার সাহস করেই উঠে পড়লাম। একটা ম্যাট্রেস জড়িয়ে আছে একটা সাদা কুঁচকানো কাপড়ে। মাথার ঠিক উপড়ে দারুণ কাঁচের একটা ছোট জানালা। এই জানালা দিয়ে আকাশভরা তারা দেখতে কেমন লাগে, তা দেখার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠল। এরপর শুধুই মুগ্ধতা ! তারাভরা আকাশ আমার মাথার উপর কাঁচের জানালা দিয়ে আমার চোখের সামনে নেমে এল। তবে ভোরের আলোটা ছিল আরও ভয়ংকর সুন্দর !
ঝোপ আর সকাল
জীবনে আমি বোধ হয় হাজার হাজার বার ভোর দেখেছি কিন্তু গভীর প্রকৃতিতে ভোর একদম অন্যভাবে ধরা দেয় । যে প্রকৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমরা নগর গড়েছি, সেই নগরকেই ছেড়ে দিয়ে আমাদের বারবার প্রকৃতির কাছে ফিরতে হয়। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ অনেকাংশে আবেগী।
ভোরের আলো যখন রাতের অন্ধকার চাদর ফেলে বের হতে শুরু করলো তখনই আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেলো। বাচ্চারা আর তাদের বাবা তখনও বিছানায় নিঃসারে ঘুমাচ্ছে। আর আমি ভোর দেখবো বলে গতরাতে বেশখানিক ঘুমিয়ে নিয়েছি। আমাদের ভাড়া ঘরটায় প্রয়োজনীয় সব কিছু আছে। মূল দরজার সাথেই ছোট একটা রান্নাঘর। কাঠের ঝকঝকে কিচেন কাউন্টারের উপর দুটো গ্যাসের চুলা। পাশেই দিয়াশলাই রাখা আছে। যখন ইচ্ছে জ্বালিয়ে নেয়া যায়। আর কাউন্টারের এক কোণে ছোট একটা বেসিনের পাশে মোটা বাদামি রঙের কাগজ রাখা, যা ভেজা হাত মোছার জন্য ব্যবহার করা হয়।
চায়ের জন্য গ্যাসের চুলাটা জ্বালাতেই ধপ করে আগুনটা জ্বলে উঠল। আগুনের রূপ আর তেজ অনেকটা মুখরা, অহংকারী রমণীর মতো, যে দাউদাউ করে জ্বলে। জলদি লাল চা বানিয়ে বড় কাচের জানালার পাশে আদ্যিকালের রংচটা একটা দুলানো চেয়ারে বসলাম, ততক্ষণে ভোরের আলোয় চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ঘরটার সামনে থাকা ঝোপ থেকে ডালপালা জানালার উপর উঁকি দিয়ে আছে। ডালের সম্মুখ ভাগে কিছু নতুন শিশু পাতা ভোরের আলোয় হেসে উঠছে। জীবনে বহু ভোর দেখেছি তবে নিবিড় প্রকৃতিতে ভোর যেনো আলাদাভাবে মুগ্ধ করে। ভোরের সাদা আলোর উত্তাপ চারদিক ছড়িয়ে যাচ্ছে।
পুরো ঘরময় কেমন একটা ভ্যাপসা আটকানো গরম। এমনটা থাকারই কথা। ঘরে এক দরজা ছাড়া কোনো জানালা নেই, তাই বাতাস চলাচল করারও কোনো সুযোগ নেই। ঘরের উপর কোন গাছ পালা না থাকায় সূর্যের তাপে ঘরে থাকার কোন উপায় নেই। একটা ইলেকট্রিক পাখা যাও ঘরের এক কোণে রাখা আছে , গরমের এতো দাপট যে পাখা খুব জুড়ে ঘুরেও পেরে উঠে না। তাই বাধ্য হয়েই দরজা খুলে কাঠের চৌকাঠে পেরিয়ে বাইরে বের হলাম। বারান্দাটা বেশ সুন্দর। একদম আমার মনের মতো! একটা সরু কাঠ দিয়ে ঘেরাও দেয়া বারান্দাটা নিমিষেই মন কেড়ে নেয়। তার ঠিক নিচের দিকে তিন ধাপের একটা কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে।
কতো ঝোঁপ-ঝাড় দেখেছি জীবনে, কিন্তু এমন সবুজ, শান্ত আর নিবিড় ঝোপ কমই দেখেছি। পাতলা কাঠের উপর চাটা রেখে ভাবছিলাম, প্রকৃতি কতোই না সুন্দর, আর এর কি নিদারুন অপচয়!
চাঁদের বন্যা আর ভয়ংকর সুন্দর রাত
বেলা গড়িয়ে দুপুর হতেই দিনের আলো ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। বিকেল হল বলে। ঝোঁপের নিচে বিকেলের রূপটাও একদম অন্যরকম, কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া একটা ভাব। মনে হল খুব কাছে কেউ মাটির উনুনে রান্না বসিয়েছে। এমন বিকেল এর আগে দেখেছি বলে মনে হয় না। এখানে খাবার বলতে বারবিকিউ আর সালাদ। ঘরে খুব ছোট একটা ফ্রিজ ছিল। এর ভিতর এত কম জায়গা যে বাচ্চাদের খাবার দিয়েই ভরে গেছে। বাসা থেকে একটা কুলার নিয়েছিলাম, আমাদের আপাতত তাই ভরসা।
রাতের খাবার সন্ধ্যা হবার আগেই শেষ করা ভালো।বিদ্যুতের লাইন থাকলেও, ওখানে ইচ্ছে করেই কেউ আলো জ্বালায় না । বাথরুমও অনেক দূর, হাতে টর্চ লাইট নিয়ে যাতায়াত করতে হয়। অন্ধকারে টর্চের আলোয় পথ চলতে চলতে মনে হলো সেই নানু বাড়ির কথা। মামা খালাদের হাত ধরে ছোট বেলায় ভয়ে ভয়ে যখন বাড়ির পথে পা বাড়াতাম।বেলা পড়ে যাচ্ছে তাই জলদি করছিলাম। কিন্তু সব খাবার তৈরি করতে একটু দেরি হয়ে গেল। যখন বাইরে খেতে বসেছি তখন ঝোঁপের উপর চোখ পড়লো। হালকা মেঘে ঢাকা একটা অর্ধবৃত্ত চাঁদ। এমন চাঁদ আগে দেখেছি বলেও খুব একটা মনে পড়ে না।
কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা তার গায়ে কালো চাদর জড়াতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে অন্ধকার নেমে এলো। এদিকে মশার আর পোকা-মাকড়ের উৎপাত চোখে পড়ার মতো। বাচ্চারা এমন গ্রামের পরিবেশ পেয়ে খাবার খেয়েই ,সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতের দিকে গরম একেবারে কমে যাওয়াই চারপাশে একটা ঠাণ্ডা ভাব। বাইরে এত মশা আর পোকা মাকড় যে দরজা খুলার সাথে সাথে তারা হুড়োহুড়ি করে ঘরের ভিতর ঢুকতে চায়। বাচ্চারা ঠিক আছে কিনা দেখে বাইরে এসে বসলাম ।
ক্যাম্প ফায়ারের জন্য কিছু কাঠ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম। রাত হতে হতে তা শেষ হয়ে গেছে। বিকেল বেলা মেইন অফিসে গিয়ে কিছু কাঠ অর্ডার দিয়ে এসেছি। অফিস এতো দূর যে মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যেয়ে আবার ফেতর আসতে হাঁফ ধরে যায়। যাবার পথে প্রতিবেশীদের আজ চোখে পড়লো। বিকেল পাঁচটায় তারা রাতের খাবার শেষ করে ফেলে। কেউ কেউ তখনও খাচ্ছিল, কারও কারও জায়গায় দুই গাছের মাঝখানের দড়িতে দুপুরের গোসলের ভেজা কাপড় ঝুলানো। বিদেশিরা এতো সৌখিন আর পরিচ্ছন্ন যে এমন গ্রাম্য পরিবেশেও তারা পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে। কারো ঘরের সামনে ঝুলন্ত টবে নানা রঙের বাহারি ফুল ঝুলে আছে। কেউ কেউ বসে চা খাচ্ছে। ফিরতি পথে ওদের দেখে মনে হল,তারা কেবল শৌখিন নয়,তাদের যাপিত জীবনের পদ্ধতিও সুন্দর। কেউ কেউ হয়তো এক দুই সপ্তাহ বেশি থাকবে এখানে তবুও তারা ভীষণ রকম পরিপাটি ! কারও কারও জায়গায় দড়িতে ঝুলানো ভেজা কাপড় দেখে, দেশের গ্রামের কথা মনে পড়ে গেল। এদিকে বেলা গড়াচ্ছে তাই ঘরে ফিরে কাঠ দিয়ে বিকেলের আগুনটা জ্বালিয়ে নিলাম। ক্যাম্পিংয়ে এই আগুন আলাদা মাত্রা যোগ করে। এই আগুন ছাড়া ক্যাম্পিং অপূর্ণ।
যখন রাত নেমে এল তখন টের পেলাম প্রকৃতির মাঝে কোনো অহংকার নেই। সে নির্বিকার ভাবে শুধু দিতে ভালোবাসে। আকাশের দিকে অন্ধকারে চোখ পড়তেই দেখি, আকাশে তারাদের জ্যাম। উজ্জ্বল, অনুজ্জ্বল, ছোট আর বড় সব তারারা ঝোপের উপর ভিড় জমিয়েছে। আমাদের সামনে আগুনের দাউদাউ করে জ্বলতে দেখে মনে হল প্রতিটি জিনিসের ধর্ম আছে। আগুনের কাজ হল জ্বালানো। আর তাকে আমরা মোমবাতির উপরেই রাখি কিংবা যে কোনো কিছুর উপরে, সে ঠিক তার কাজ করবে।
রাত গড়িয়ে তখন বারোটা। চারপাশ থেকে প্রতিবেশীদের কথাবার্তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। আমাদেরও শোবার সময় হল। হঠাৎ খেয়াল করলাম চাঁদ এসে ঠিক ঝোপের উপর বসেছে। চাঁদের আলোয় কাঠের বারান্দাটা ভেসে যাচ্ছে। বরকে বললাম, একটু অপেক্ষা কর বাইরে, আমি এখনই আসছি। সে স্মান হেসে বাইরে বসে রইল। ঘরের ভিতরে ঢুকে জলদি দুই কাপ চা বানিয়ে দুটো প্ল্যাস্টিকের চেয়ার টেনে বারান্দায় বসলাম। বিবাহিত জীবনে আমি বহুবার তার সঙ্গে বসে চাঁদের আলোয় চা খেয়েছি। তবে এমন পরিবেশে কখনও নয়। মাথার উপর তারাভরা রাত আর চাঁদ যেন আজ তাদের সবটুকু রূপের ঝাঁপি খুলে দিয়েছে। আমাদের চায়ের কাপে চাঁদের আলো এসে আনন্দে ঢেউ তুলে সাঁতার কাটছে। এমন পরিবেশে আমার মনে আনন্দ উপচে পড়ছিল। গভীর রাতে প্রকৃতি খুব নিবিড় হয়ে উঠে, প্রকৃতির এমন আলিঙ্গন ছেড়ে ঘুমিয়ে থাকলে তা ঠিক টের পাওয়া যায় না। কি দারুণ রাত আর এমন চাঁদের আলোর বন্যা রেখে কি করে ঘুমাতে যাই ! চারপাশ একদম নিরব হয়ে উঠেছে। আশপাশের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে মন হল।
আমার পাশে বসে থাকা মানুষটার শিরা উঠা হাত ধরে মনে মনে বলছিলাম, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে এমন একটা জায়গায় আমাকে নিয়ে আসার জন্য। আমি খুব করে চাইছিলাম তার মনের সঙ্গে আমার মনঃ সংযোগ ঘটে যাক । আমি যে তাকে ধন্যবাদ দিয়েছি সে কথা সে বুঝতে পারুক । বর মনের কথাটা বুঝল কিনা জানি না তবে চাঁদের আলোয় তাকে সেদিন খুব সুন্দর লাগছিল ! তার ঘন মসৃণ চুলে আলো পিছলে পড়ছে। আচমকা মনে হল সে আমার কথা বুঝতে পেরেছে ! চা খেতে খেতে সেদিন দেখেছিলাম তার ঠোঁটের কোণে ঝুলে পড়েছে, পড়ন্ত বিকেলের মতো সেই মিষ্টি হাসি যা আমার খুব প্রিয় !

এমন আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ বিনোদন