তিনি ছিলেন ফটোগ্রাফি আন্দোলনের পুরোধা

আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগ। ছবি : নাসির আলী মামুন

আমি মনে করি বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়েছে। এই তিন স্তম্ভ হলেন, গোলাম কাসেম ড্যাডি, মনজুর আলম বেগ ও শহিদুল আলম। বাকি পূর্বসূরীরা হলেন একেকটি ছাদ। আর আমাদের প্রজন্ম সে স্থাপনার বাসিন্দা। ড্যাডির বিচরণ প্রধানত ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বিস্তৃত। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আধুনিক ফটোগ্রাফিচর্চা শুরু হয় মূলত আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগের হাত ধরেই। আজ তার ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী।

এই ধীমান মানুষটিকে আমি পাইনি। আমি যখন ফটোগ্রাফি শুরু করি তার অনেক আগেই তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। ফটোগ্রাফিচর্চার গোড়া থেকেই তার কথা জানি। জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্রী যার কাছেই গিয়েছি—তার কাছেই শুনেছি বেগ স্যারের কথা। বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির গণ্ডিতে তার মতো খুব কম মানুষই আছেন যার শুধু প্রশংসাই শুনেছি আমি। কারো কাছে কখনো শুনিনি তার কোনো নেতিবাচক দিকের কথা। অনেকের স্মৃতিচারণ থেকে বু্ঝতে অসুবিধা হয়নি—বেগ সাহেব দিতে পছন্দ করতেন, সবাইকে নিয়ে কাজ করায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন।

তার হাতে ধরে দেশের ফটোগ্রাফি কতদূর এসেছে তার জ্বলজ্বলে ছবি আমাদের সামনে। গোলাম কাসেম ড্যাডি, মনজুর আলম বেগ ও শহিদুল আলম—এই ত্রিরত্ন বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির উন্নয়নে যা করেছেন তার জন্য আমরা চিরঋণী। ড্যাডির যোগ্য উত্তরসূরী এমএ বেগ, আর তাদের যোগ্য উত্তরাধিকারী শহিদুল। এমএ বেগ তার সময় থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন তাতে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু রাষ্ট্র তাকে একুশে পদকে সম্মানিত করলো তার মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পর!

মনজুর আলম বেগ। ছবি : মাকসুদুল বারী

এমএ বেগের বাবা ছিলেন অধ্যাপক, বড় ভাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এবং ছোট ভাই মহান মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার। আর মনজুর আলম হলেন আলোকচিত্রী। সম্ভবত পারিবারের সাংস্কৃতিক আবহ তাকে ফটোগ্রাফির দিকে নিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে। তৎকালীন পাকিস্তানে একাধিক ফটোগ্রাফি-কোর্স করেন তিনি। তারপর বিলেতে যান কোর্স করতে। স্বাধীনতার পর তিনি আবার বিলেতে যান এবং ফটোগ্রাফিতে ডিপ্লোমা করেন।

বিলেত থেকে ফিরে তিনি কি করলেন? ‘বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। তারও আগে গড়ে তোলেন ‘বেগার্ট ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি’। ইনস্টিটিউট করেছিলেন ফটোগ্রাফি শিক্ষা আদান-প্রদান করতে আর সোসাইটি করলেন সারাদেশের আলোকচিত্রীদের এক ছাতার নিচে জড়ো করতে, নিজেদের মধ্যে সংযোগ বাড়াতে। যারা বেগ সাহেবের সান্নিধ্য পেয়েছেন তারা বলেন, স্যার সবসময় নতুন কিছু করতেন এবং নিজের জ্ঞানকে অন্যের মাঝে বিলিয়ে দিতে চাইতেন। শহিদুল আলমের ভাষায়, ‘উনার জীবনে ফটোগ্রাফির বাইরে অন্য কিছু আছে আমার মনে হয়নি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ফটোগ্রাফি নিয়েই উনার চর্চা।…তার দরজা সবসময় খোলা ছিল। যখন যে আসতো তার সাথে বসতেন, কথা হতো, আড্ডা হতো। বইপত্র যোগাড় করতেন, একটা কিছু জানলে অন্যদের জানাতেন। উনার বিশাল একটা দেবার ক্ষমতা ছিল যেটা আমি খুব বেশি মানুষের মধ্যে দেখি নাই।’

মনজুর আলম বেগের ছবি

তার নিজের ফটোগ্রাফিচর্চার মধ্যেও ছিল তার ব্যক্তিত্বের ছাপ। তার করা সাদাকালো ছবিগুলোতে সৌম্যতা ও সহজিয়া ভাব স্পষ্ট। যেমন ধরুন, মাটির ঘরের মেঝেতে বসা দুই শিশু ও দুই কলসের ছবি কিংবা এক কিশোরীর কোরান পড়ার ছবিটি। দৃশ্যগুলোতে কোনো জঞ্জাল নেই—দৃষ্টিকে বাধাগ্রস্থ করে এমন কোনো প্রতিবন্ধকতাও নেই। সাদাকালো টোনেও একটা মাদকতা আছে। খুবই যত্ন করে বিষয়বস্তুকে ফুটিয়ে তোলা। বেগ সাহেব নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছেন।

মনজুর আলম বেগের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ

প্রতীকী ও স্টিল লাইফ ছবির চলও তার হাত দিয়েই হয়েছে। দেশজ সাধারণ বিষয়বস্তুকে পশ্চিমা ভাবধারায় ছবিতে ফুটিয়ে তোলার চর্চা তিনি করতেন। তিনি যে সময় ক্যামেরাকে শিল্পকর্ম ‘সৃষ্টির মাধ্যম মাত্র’ বিবেচনা করতেন সেসময় ক্যামেরা ফটোকপি মেশিনের মতো ব্যবহার হতো। সত্তরের দশকে তিনি বলছেন, ‘আর্ট কোনো নিয়মের মধ্যে ফেলে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। তা করতে গেলে আর্ট আর্ট থাকে না, বিজ্ঞান হয়ে যায়। শিল্পীর কাজ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে মনকে আন্দোলিত করা।’ ক্যামেরা দিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত ওই ‘নতুন দৃষ্টিভঙ্গি’টাকেই খুঁজেছেন।

মনজুর আলম বেগ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আবর্তিত হতে পারেন না, তিনি সবার, তিনি সবারই হতে চেয়েছিলেন। তিনি ফটোগ্রাফি করেছেন, লিখেছেনও। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই অনন্য প্রতিভাধর মানুষটিকে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রয়োজন তার সৃষ্ট ছবি ও গ্রন্থগুলোর পুনঃউৎপাদন। বেগ স্যারকে পাঠের মাধ্যমেই প্রকৃত অর্থে তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখা যাবে।

সুদীপ্ত সালাম দৃশ্যগল্পকার ও লেখক

এমন আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ বিনোদন