প্রতিটি চরিত্রের প্রতি ছিল তার দরদ

হুমায়ুন ফরিদী। ছবি : সংগৃহীত

হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিক নাটক যখন ১৯৯৩ সালে বিটিভিতে সম্প্রচারিত হয় তখন আমার বয়স দশ। সবগুলো পর্ব দেখেছি। কিন্তু সব মনে নেই। বাকের ভাই, মুনা, বদি, মজনু—এমন কিছু চরিত্র এবং চরিত্রে যারা অভিনয় করেছিলেন তাদের কথা মনে আছে। হুমায়ূন আহমেদ নামে কোথাও কেউ আছেন তাও জানতাম না, শুধু জানতাম ‘কোথাও কেউ নেই’। এই নাটক নিয়ে সেসময় যেসব কাণ্ড ঘটেছে তা অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশে এর আগেপরে আর কোনো নাটক নিয়ে এতো উৎসাহ ও হইচই দেখা যায়নি। বাকের ভাইয়ের যেন ফাঁসি না হয় সে দাবিতে লোকজনকে ট্রাকে করে র‍্যালি করতে দেখেছি।

আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি, অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীর মৃত্যুবার্ষিকী

যাহোক। গত কয়েকদিনে ইউটিউব থেকে সেই ‘কোথাও কেউ নেই’-এর সবগুলো পর্ব ফের দেখে ফেললাম। আমার একেবারেই মনে ছিল না, এই নাটকে হুমায়ুন ফরিদীও ছিলেন। চরিত্রটি ছোট কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছিলেন বাকের ভাইয়ের উকিলের ভূমিকায়। সেসময় এই নাটক দেখে কতজনকে কাঁদতে দেখেছি তার হিসেবে নেই। আমি কেঁদেছি বলে মনে পড়ে না। এবার অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নাটকটি দেখা শেষ করলাম, শেষপর্বের আগের পর্ব পর্যন্ত অটুট ছিল দৃঢ়তা। শেষপর্বে এসে উকিল ইয়াকুব সাহেব ওরফে হুমায়ুন ফরিদীর একটি ছোট্ট সংলাপ আবেগের বাঁধ ভেঙে খান খান করে দিলো। বদি যখন মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে আদালত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন তাকে হুমায়ুন ফরিদী বলেন, ‘এই মামলা আমি ধুলোয় উড়িয়ে দিতে পারতাম বদি, তোমার জন্য পারিনি।’ ছাপার অক্ষরে দেখলে খুবই সাদামাটা একটি সংলাপ। কিন্তু টিভির পর্দায় সংলাপটি দেখে ও শুনে চোখ ছলছল করে উঠলো। চোখের পানি থামানো গেলোই না। একজন নিরাপরাধ মানুষকে ফাঁসি থেকে বাঁচাতে না পারার গ্লানি, পরাজয়, কষ্ট—যাই বলি না কেন তা এই একটি সংলাপে পুঞ্জিভূত করেছেন হুমায়ুন ফরিদী। এটি একটি ‘বিগ ব্যাং’ সংলাপ বলা যায়। ছোট্ট কিন্তু অভিনয়ের গুণে বিস্ফোরক।

হুমায়ুন ফরিদী। ছবি : সংগৃহীত

অভিনয়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে একটি ছোট্ট লাইনও যে যথেষ্ট তা ফরিদী করে দেখিয়েছেন। কি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ! কি এক্সপ্রেশন! কি টাইমিং! ‘ধুলোয় উড়িয়ে দিতে পারতাম’ অংশটুকু বলার সময় তিনি তুড়ি মারেন, সেই তুড়ির শব্দ কানে বাজতে থাকে গোটা নাটক শেষ হয়ে যাওয়ার পরও। এই সংলাপে আমার চোখে পানি আসার দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত উকিল ইয়াকুবের পরাজয়কে ধারণ করে এবং দ্বিতীয়ত অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীকে স্মরণ করে। ওই সংলাপ আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলো আমরা তার মতো একজন মহান অভিনেতাকে অকালে হারিয়েছি, যাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়নি, যিনি তার মুনশিয়ানার অধিকাংশই অপচয় করেছেন। তার কাছ থেকে আমাদের অনেক—অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আমাদের গর্ব করে বলার সুযোগ ছিল, ‘আমাদের একজন হুমায়ুন ফরিদী আছেন’।

রুশ মঞ্চ অভিনেতা কন্সট্যান্টিন স্ট্যানিসলাভস্কি বলেছিলেন, ‘মনে রাখবে, ছোট চরিত্র হয় না—শুধু হয় ছোট অভিনেতা।’ হুমায়ুন ফরিদীও কি এমনটি মনে করতেন? যতটুকু যত্ন দিয়ে তিনি বড় চরিত্রকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তুলতেন ঠিক ততটা যত্ন নিতেন ছোট চরিত্রগুলোর। ‘দহন’ সিনেমার মুনির এবং ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের ইয়াকুব চরিত্র তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ। যেকোনো চরিত্রকে তিনি নিজের করে নিতেন, নিজেকে তিনি একাকার করে দিতে পারতেন কাল্পনিক চরিত্রে। আর এজন্যই তার করা চরিত্রগুলো মানুষের মনে এখনো তারার মতো উজ্জ্বল।

প্রয়াত নাট্যব্যক্তিত্ব আতিকুল হক চৌধুরী এই ধীমান অভিনয়শিল্পী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘হুমায়ুন ফরীদির মতো শিল্পী যেকোনো দেশে জন্মাতে যুগ যুগ সময় লাগে, শতাধিক বছর লাগে।’ কিন্তু আমরা তাকে চিনিনি। যেটুকু তিনি দিয়েছেন তার জন্যও এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা সময় থাকতে সম্মান দিতে পারিনি। মৃত্যুর পাঁচ-ছয় বছর পর তাকে একুশে পদক দিলাম। মৃত্যুর পর এসবে কার কি আসে যায়? এই সম্মান আসলে কে পায়?

সুদীপ্ত সালাম দৃশ্য-গল্পকার ও লেখক
ইমেইল ঠিকানা : dakgharbd@gmail.com

এমন আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ বিনোদন