‘হাউস অব সিক্রেট্স’ একটি শ্বাসরুদ্ধকর তথ্যচিত্র

ছবির সবাই গলায় ফাঁস দিয়ে মারা গেছেন

তথ্যচিত্রটিকে মোট তিন পর্বে ভাগ করেছেন এর নির্মাতা লীনা যাদব ও অনুভব চোপরা। প্রথম দুই পর্ব দেখে আপনার মনে হবে দেখা শেষ, গল্প শেষ—আপনার আর কিছু জানার নেই। অনেক ক্ষেত্রে অহেতুক কথা এবং বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি দিয়ে পর্বসংখ্যা বাড়ানো হয়। নেটফ্লিক্সের ‘কনভারসেশন্স উইথ এ কিলার : দ্য টেড বান্ডি টেপস’ দেখে তাই মনে হয়েছিল। তবে এই তথ্যচিত্রের দ্বিতীয় পর্ব শেষ হওয়ার পর আপনার মনে হবে তৃতীয় ও শেষ পর্বটি নিশ্চয়ই অকারণে করা। কেননা প্রথম দুই পর্বেই তো ঘটনা স্পষ্ট। কিন্তু আসলে তা নয়, তৃতীয় পর্ব দেখার পর বুঝা যায়—তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, মনে হতে পারে, এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। শেষ পর্ব যখন শেষ হয় তখনও দর্শক টিভির সামনে থেকে নড়তে পারেন না। কিছু বিস্ময়সূচক প্রশ্ন দর্শকের মাথায় কিলবিল করতে থাকে। ‘কিভাবে সম্ভব!’ ‘কেন!’, ‘এটা কিছু হলো!’ দেখা শেষে তৃপ্তি ও অস্বস্তি দর্শকে বুঁদ করে রাখে, কয়েক মিনিট বা কয়েক ঘণ্টা—অনেক ক্ষেত্রে কয়েকদিন।

বলছি ৮ অক্টোবর মুক্তি পাওয়া নেটফ্লিক্সের বহুল আলোচিত ডকুমেন্টারি সিরিজ ‘হাউস অব সিক্রেট্স : দ্য বুরারি ডেথ্স’-এর কথা। ২০১৮ সালে দিল্লির একটি বাড়ি থেকে একই পরিবারের ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। বাড়ির সবাই গলায় ফাঁস দিয়ে মারা যান। সবার হাত শরীরের পেছনে বাঁধা, চোখমুখ কাপড় দিয়ে মোড়ানো এবং কানে তুলা দেয়া! শিশু থেকে বৃদ্ধ—পরিবারের তিন প্রজন্মের ১১ জন একসঙ্গে শেষ! একই পরিবারের এরচেয়ে বেশি মানুষ হয়তো আগেও মরেছে বা খুন হয়েছে—কিন্তু ‘বুরারি গণমৃত্যু’ মরদেহের সংখ্যার কারণে নয়—মৃত্যুর পেছনের রোমহর্ষ কারণের জন্য অদ্বিতীয়। আর এই কারণ সম্পর্কে গভীরভাবে জানতেই যেতে হবে তথ্যচিত্রের তৃতীয় পর্বে।

তথ্যচিত্রটি আপনাকে একটি অতুলনীয় অভিজ্ঞতা দেবে। এমন এক মনোজগতের সন্ধান দেবে—যা পেয়ে আপনি হতবাক হয়ে যাবেন। জোরসে একটা ধাক্কা খাবেন। আর এই ধাক্কার রেশ আপনাকে বয়ে বেড়াতে হবে অনেকদিন। কেন? কারণ আপনি হিসেব মেলাতে পারবেন না, কারণ তা ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’। পরিবারে কি চলছিল সেসম্পর্কে জানা যায় বাড়িটি থেকে পাওয়া কিছু খাতা থেকে। মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মেলে খাতাগুলোর বয়ান থেকে। পুলিশকে বাঁচিয়ে দেয় এই বিশেষ আলামত। কিন্তু সাধারণ মানুষের সামনে তারপরও অনেক প্রশ্ন দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়ির কেউ বেঁচে নেই। ঠিক কি কি ঘটছিল তা যারা দেখেছেন তাদের কেউ নেই। তাই ঘটনার পেছনের মূল কারণ জানা গেলেও অনেক সূক্ষ্ম প্রশ্নের জবাব আজো মেলেনি। যেমন একটি প্রশ্ন, সবাই কি স্বেচ্ছায় ফাঁসিতে ঝুলে পড়তে রাজি হয়েছিল? তথ্যচিত্রের দর্শকেরাও উত্তর খুঁজতে থাকেন। প্রশ্নের গহ্বরে তলিয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। এ হিসেব মিলবে না। মস্তিষ্কের ক্যামিস্ট্রি বড় দুর্বোধ্য। এই ঘটনা তার প্রমাণ।

এই ১১ জন একসঙ্গে মারা যান

বাস্তব ঘটনা এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত প্রতিটি উপাদান ও চরিত্রকে এই তথ্যচিত্রে হাজির করা হয়েছে, যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের আত্মীয়, বন্ধু ও প্রতিবেশী, তদন্তকারী পুলিশ, সমাজবিজ্ঞানী, ফরেনসিক বিভাগের সদস্য, চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, সাংবাদিক, হাতের লেখা বিশেষজ্ঞ—এমন বহু লোকের বক্তব্য এবং দুর্লভ সব ছবি ও ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। যা এই ঘটনার খুঁটিনাটি বুঝতে সাহায্য করে। ধারাভাষ্যের প্রয়োজনে অনেক দৃশ্য পুনরুৎপাদন করা হয়েছে (ফিকশনাইজ), তবে সরাসরি ‘ফিকশন’ দেখানো হয়নি। আমার ধারণা, ইচ্ছে করেই ক্যামেরার কাজকে নিখুঁত ও ‘পারফেক্ট’ হতে দেয়া হয়নি। খুবই মামুলি সব ফ্রেম, হাতে ক্যামেরা রেখে নেয়া—যাতে ফাইল ফুটেজের সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য তৈরি না হয় এবং ‘ফিল্মি’ না হয়।

পুরো তথ্যচিত্রজুড়ে রয়েছে এ. আর. রহমানের সংগীত। তার সংগীতের তুলনা হয় না। দর্শকের উত্তেজনা ও বিস্ময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে তার করা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক।

বিষয়বস্তু এমন—চাইলেই এটিকে একটি মসলাদার, চটকদার, ‘সানসানি’ টাইপ তথ্যচিত্র করা যেতো। তা একেবারেই করা হয়নি। দর্শকের মতো এর নির্মাতারাও বুরারি ট্রাজেডির মনস্তত্ত্ব বুঝতে চেয়েছেন, এর গভীরে যেতে চেয়েছেন। তবে ঘটনার সংবেদনশীলতার প্রতি তারা ছিলেন সচেতন। এতো লম্বা তথ্যচিত্র কিন্তু একবারও ফাঁসিতে ঝুলে থাকা মরদেহগুলো দেখানো হয়নি। ফাইল ফুটেজ থেকে শিশু এবং ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন মানুষের মুখ মুছে দেয়া হয়েছে। যারা রাজি হননি তাদের মুখও ঢাকা। তথ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে নীতি ও নৈতিকতা বিসর্জন দেয়া হয়নি। আর এজন্যই এই ঘটনা নিয়ে সেসময় ভারতীয় মিডিয়া যে বাড়াবাড়ি করেছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পেরেছে এই তথ্যচিত্র।

কৌশলে—ধীরে ধীরে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে। এই উদ্ঘাটন অভিযানে দর্শকও অংশ নেন। নানা দিক থেকে ঘটনাটিকে দেখা হয়েছে। সবগুলো তত্ত্বকে হাজির করা হয়েছে। নানা তথ্য ও তত্ত্বে দর্শক হাবুডুবু খেতে থাকেন। দর্শকও কিছু ধারণা ও তত্ত্ব দাঁড় করান। যেগুলো শেষে ভুল প্রমাণিত হয়।

শেষ হয়েছে একটি বড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে। এটি খুনও না—আত্মহত্যাও না—তাহলে কি? পুলিশও এই ঘটনাকে একটি বিশেষ নাম দিতে বাধ্য হয়েছিল। এটি কেন হত্যাকাণ্ড বা আত্মহত্যা নয় তা জানতে আপনাকে তথ্যচিত্রটির শেষতক দেখতে হবে।

এই বাড়িতেই থাকতেন ভুক্তভোগীরা

এমন আরো সংবাদ

সর্বশেষ বিনোদন